অভিজাততন্ত্রের ভাষার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের ভাষার বিজয়
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫:৪৭ অপরাহ্ন
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি
‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ শিরোনামের অভিভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অভিমত প্রকাশ করেন, ‘যেমন রাজনীতির ক্ষেত্রে অভিজাততন্ত্র এবং গণতন্ত্র আছে, ভাষার ক্ষেত্রেও তদ্রূপ অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র আছে।’ বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি এ চিত্র তুলে ধরেন। সময়টা ১৩২৪ সাল, যখন হোমরুল আন্দোলন প্রেক্ষাপটে ভারতে কার্যকর ভাষার দাবি প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করেছে। বক্তব্যে তিনি বৈদিক যুগ থেকে প্রাচীনকাল পর্যন্ত সময়ের ভাষার বংশপরম্পরা, উত্থানপতন, দ্বন্দ্ববিকাশ ও গতিপ্রবণতা চিহ্নিত করেছেন। স্পষ্টভাবে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত একই দ্বন্দ্ববিকাশগতি এবং অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের ভাষার বিজয় সুনির্দিষ্ট। চর্যাগীতিকা রচনার আগে এদেশে সংস্কৃত; নয়তো প্রাকৃত ভাষায় সাহিত্যচর্চা হতো। ব্রাহ্মণ্য সেন শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নিম্নশ্রেণির অপভ্রংশ প্রাকৃতের ওপর জয়যুক্ত হলেও বাঙালিরা একদিকে বঞ্চিত হয় দেবভাষায় প্রবেশাধিকার থেকে, অন্যদিকে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেও হয় পরিত্যাজ্য। বিদেশি-বিভাষী সেন রাজাদের রুদ্ররোষ থেকে বাঁচার জন্য সহজিয়া সিদ্ধারা হয় নিজ দেশে পরবাসী। কেউ কেউ আশ্রয় নেয় প্রান্তিয় পাহাড়ি অঞ্চলে। মধ্যযুগে দেখা যায় দিল্লির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন সুলতানরা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে বেছে নেয় নদীমাতৃক বাংলাকে। সুলতানি আমলে বাংলা ভাষার রাজধানী স্থাপিত হয় দিল্লি থেকে দূরবর্তী গৌড়ে, গঙ্গানদীর পশ্চিম তীরে। মোগল আমলে স্থাপিত হয় আরও দূরবর্তী দক্ষিণ চট্টগ্রামে, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে। আফগান সরদার খাজা ওসমান মোগলদের সঙ্গে প্রকৃত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য যেমন সতেরো শতকে বেছে নেন বোকাইনগর ও সিলেটকে।
ব্রিটিশ আমলে ফারসি ভাষার জায়গা দখল করে নেয় ইংরেজি। ঔপনিবেশিককালে ইংরেজি ভাষা তার সহযোগি হিসাবে নিয়োগ করে প্রথমে উর্দুকে, পরে হিন্দিকে। আঠারো-উনিশ শতককে বলা যায় প্রধান দুই ভাষা উর্দু ও হিন্দির দ্বৈরথ কাল। ইংরেজির পর উর্দু ছিল ভারতের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা। সম্মুখযুদ্ধে প্রথমে জয়লাভ করে উর্দু, পরবর্তীতে তার স্থলাভিষিক্ত হতে থাকে হিন্দি। উত্তরাধিকারসূত্র না মানায় মোগল রাজপুত্রদের মত লিপ্ত থাকে বিরামহীন ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ ও সংঘাতে। এসময় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সর্বশেষ সদস্য বাংলা একপ্রান্তে অধিষ্ঠিত হয়ে নির্জন রেনেসাঁয় নেতৃত্ব দেয়। হিমালয় ও দক্ষিণ এশিয়ার শেষ সীমানায় অবস্থিত এই ভাষার যত বিদ্রোহ, নির্জনবাস ও সমুন্নতি- সবই ইন্দো-ইউরোপীয় এক প্রান্তিক ভাষার নিজস্ব সাধনার ফসল।
পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলা রাজনৈতিকভাবে না হলেও ভৌগোলিকভাবে আবির্ভূত হয় স্বাধীন সত্তা হিসাবে। যদিও রাজনৈতিক কারণে তার ওপর চেপে বসে হাজার মাইল দূরবর্তী উর্দু উপনিবেশবাদ। ব্রিটিশ আমলে উত্তর প্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলে যাদের উর্দুই ছিল মাতৃভাষা-ভারতভাগের পর নিজ আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রশাসিত লাদাখ ও জম্মু কাশ্মীরে। তাদের একটি অংশ উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বিহার থেকে বিতাড়িত হয়ে পূর্ববাংলায় এসে উর্দুর রাজত্ব কায়েমে উদ্যোগী হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়কদের তুলনা করা যায় ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে। ওয়ারেন হেস্টিংস আমেরিকার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভারতে এসে পাকাপোক্ত করে তার ঔপনিবেশিক শাসন। গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক ফার্সির বদলে চালু করেন ইংরেজি ভাষা, তার শতবর্ষ পরে একই রকমভাবে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহম্মদ আলী জিন্নাহ্ বাংলাকে বাদ দিয়ে এদেশে প্রচলন করতে চাইলেন উর্দু ভাষা।
তবে মধ্যযুগে যেমন, তেমনি আধুনিক যুগে এদেশে আভিজাত্যের ভাষা পরাজিত হয়েছে গণতন্ত্রের ভাষার কাছে। মধ্যযুগে আলফে সানির (১৫৬৩-১৬২৪) অভিজাত উর্দু পরাজিত হয়েছে হজরত শাহজালালের সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দিনের বংশধর সৈয়দ সুলতানের বাংলাভাষার কাছে। আলফে সানি ছিলেন খলিফা ওমরের বংশধর, তার ভাষা পরাজিত হয়েছে হজরত আলির বংশধর সৈয়দ সুলতানের কাছে। আধুনিক যুগে আবদুল লতিফের অভিজাত উর্দু পরাজিত হয়েছে ড. শহীদুল্লাহর বাংলা ভাষার কাছে। নবাব আবদুল লতিফ ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদের বংশধর, তাদের ভাষা পরাজিত হয়েছে হজরত শাহজালালের সহযোদ্ধা গোঁরাচাঁদ পিরের খাদেমের বংশধরদের কাছে। মীরজাফরের বংশধর ইস্কান্দর মীর্জার ভাষা পরাজিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে আসা পাটচাষীদের সন্তানদের ভাষার কাছে। প্রাচীনকালে বাংলা জয় করে কর্ণাটকের ব্রাহ্মক্ষত্রিয়দের বিজয়রথ। সেন রাজারা মহারাষ্ট্রী ভাষাভাষী হলেও চালু করে সংস্কৃত। মধ্যযুগে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে এসে উপনিবেশ স্থাপন করে তুর্কি-আফগান-মোগল। তাদের বাহন ছিল ঘোড়া। ইউরোপ উপনিবেশ স্থাপন করে সমুদ্রপথে, বাহন ছিল মৌসুমি বায়ুচালিত জাহাজ। এদেশে যুগে যুগে উপনিবেশ স্থাপন করেছে ইন্দো-ইউরোপীয় দেশগুলো। মধ্যযুগে ইরানিয় ভাষা প্রভুত্ব স্থাপন করেছে বাংলার ওপর, আধুনিক যুগে ইউরোপীয় ভাষা। এদেশে কখনো প্রভুত্ব স্থাপন করেনি তিব্বতি-বর্মী ভাষা। জাপান ঔপনিবেশিক ডানা মেলে দিয়েছিল অ-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার ওপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আজাদ হিন্দের সক্রিয় সমর্থন সত্ত্বেও জাপান কিন্তু অতিক্রম করতে পারেনি কোহিমার মাটি। তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তিব্বতি-বর্মী ভাষার ভেতরেই।
এখন ইংরেজির সূর্যগ্রহণের করাল গ্রাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দির চন্দ্রগ্রহণ। ইংরেজি ও হিন্দি হচ্ছে এমন দুটি ভাষা-যে ভাষা বিচিত্রসম্পদ আহরণে দক্ষ। এর তুলনায় বাংলাদেশকে তুলনা করা যায় সেই দেশের সঙ্গে-যে দেশ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ, কিন্তু যার নেই প্রত্নতাত্ত্বিক সোনা উত্তোলনের প্রযুক্তি। যার জন্য সে পরসম্পদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে নিজের অস্তিত্বকেই বিসর্জন দিতে চলেছে। বিদেশি উপনিবেশবাদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য চাই রক্ষাকবচ। সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হতে পারে ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়। উপনিবেশবিরোধী ভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে অবতীর্ণ হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিংশ শতাব্দীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরই পাথরের বোঝা বাড়ায় ঈপ্সিত সাফল্য লাভ করতে পারেনি। কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর তার গৌরব ম্লান থেকে ম্লানতর হতে শুরু করে। একইভাবে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানীতে স্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হলেও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করতে ব্যর্থ হয়।
শুধু আজাদি লাভের পরই ভারত ও পাকিস্তান ভাষাবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ভাষা সংরক্ষণে সফল হতে শুরু করে। হিন্দিভাষী ভারত ও উর্দুভাষী পাকিস্তান রক্ষাকবচ পরে এগিয়ে যায়, শুধু বাংলাভাষী বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরও সুরক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। অথচ বাংলা ও হিন্দি একই অপভ্রংশজাত হলেও সৃজনশীলতা ও মননশীলতার দিক থেকে হিন্দি ছিল পিছিয়ে! দেড় শ বছর আগেও যার কোনো নিজস্ব বর্ণমালাই ছিল না, যে ভাষা ছিল অস্ত্রহীন যোদ্ধা; সে আজ শুধু সামরিক কিংবা আণবিক শক্তিধরই নয়, ভাষার ক্ষেত্রেও উপনিবেশবাদ স্থাপনে দক্ষ। মোগল আমলে ব্যারাকের ভেতর যার জন্ম, যে ভাষার ৯৯ ভাগ ক্রিয়াপদ সংস্কৃত ও প্রাকৃতজাত এবং শুধু ২৫ ভাগ শব্দ ফারসি-সেও আজ কতটা শক্তিশালী। অথচ যে দেশে জন্মেছে এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যাচার্য, যে দেশে জন্মেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী কবি, তার ভাষা আজ কতটা বিপন্ন। বিপন্ন ভাষাকে তুলনা করা যায় হতভাগ্য পাল রাজাদের সঙ্গে, যারা বিশ্বাসের দিক দিয়ে ছিলেন বৌদ্ধ; কিন্তু প্রজারা ভিন্নধর্মাবলম্বী হওয়ায় তার সুযোগ নিয়ে বিদেশি ক্ষত্রিয়রা অতর্কিত হামলা করে পাল রাজাদের উচ্ছেদ করে ও বাংলার জায়গায় প্রতিস্থাপন করে সংস্কৃত ভাষা। ভাষাবিশ্ববিদ্যালয়ই অযাচিত এ হামলা থেকে পারে মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে। অভিজাত শ্রেণিকে পরাজিত করে প্রকৃত গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিনির্মাণের জন্যও দরকার ভাষাবিশ্ববিদ্যালয়।
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ, ঢাকা mahmoodnasirjahangiri@gmail.com