গাজা থেকে ইসরাইল হাজার হাজার সৈন্য ফিরিয়ে নিচ্ছে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৪১:৪৮ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: প্রায় তিন মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গত ৭ অক্টোবর বিমান হামলার মধ্য দিয়ে এই বর্বর আগ্রাসন শুরু হয়। এরপর ২৮ অক্টোবর শুরু হয় স্থল অভিযান। দীর্ঘ এই যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় ২২ হাজার ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছে ৫৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।
গত ৭ অক্টোবর কঠোর নিরাপত্তা বলয় ভেঙে সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্ত অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস যোদ্ধারা। সেসময় তারা এক হাজার ১৩৯ ইসরায়েলি ও বিভিন্ন দেশের নাগরিককে হত্যা করে। জিম্মি করে নিয়ে আসে ২৪০ জনের বেশি ইসরায়েলি ও বিভিন্ন দেশের নাগরিককে।
ওই দিন থেকেই গাজা উপত্যকায় প্রতিশোধমূলক হামলা চালায় ইসরায়েল। ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটি ঘোষণা দেয়, হামাসকে নির্মূল করা ও জিম্মিদের উদ্ধার করা এই যুদ্ধে মূল লক্ষ্য। তবে দীর্ঘ তিনমাস পর বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে ভিন্ন।
দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করেও কোনও জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। শুধু তাই নয়, হামাসকে নির্মূল করতে গেলেও সেখানে এখনও ভীষণ প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করার পরও হামাসকে নির্মূল করতে পারেনি ইসরায়েলি বাহিনী। যদিও তাদের দাবি হামাসের সামরিক সক্ষমতা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবে ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম প্রহরে তেল আবিব-সহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে হামাসের রকেট নিক্ষেপের চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। দীর্ঘ দিন যুদ্ধ করার পরও হামাসের এই সক্ষমতা ভাবিয়ে তুলেছে অনেককেই।
এদিকে, এরই মধ্যে ইসরায়েল ঘোষণা দিয়েছে- গাজায় যুদ্ধরত পাঁচটি ব্রিগেড প্রত্যাহার করে নেবে। তিনটি প্রশিক্ষণ ব্রিগেডের পাশাপাশি ৫৫১তম এবং ১১৪তম রিজার্ভ ব্রিগেড প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। একটি ব্রিডেগে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ হাজার সেনা থাকে। সে হিসেবে ১৫ থেকে ২৫ হাজার সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে তেল আবিব।
ইহুদিবাদী সংবাদ মাধ্যম ইয়েদিওত আহরোনোথ জানিয়েছে, ইসরায়েলি অর্থনীতিকে মারাত্মক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এসব সেনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করেছে, গাজা উপত্যকার উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে তাদের লক্ষ্য ব্যাপকভাবে অর্জিত হওয়ায় এসব সেনা আর সেখানে মোতায়েন করে রাখার প্রয়োজন নেই।
ইহুদিবাদী ইসরায়েল এর আগে গতমাসে গাজা থেকে তাদের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত ও দুর্ধর্ষ গোলানি ব্রিগেড প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। গাজা থেকে বিপুল সংখ্যক সেনা প্রত্যাহারের এই ঘটনাকে ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ‘প্যালেস্টাইন ক্রনিকল’ গাজা যুদ্ধের বাস্তব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে একথা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, এই যুদ্ধে ইসরায়েলের পরাজয়ের লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
উত্তর ও মধ্য গাজায় ইসরায়েলি সেনারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করে ফেলেছে বলে যে দাবি করেছে, বার্তা সংস্থাটি তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্যাল্টেস্টাইন ক্রনিকল লিখেছে:
উত্তর ও মধ্য গাজায় লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার দাবি কি সত্য?
একেবারেই না।
গাজা উপত্যকায় যে ১৭ ব্রিগেড ইসরায়েলি সেনা মোতায়েন রয়েছে তাদের মধ্যে উত্তর গাজায় এখনও চার ব্রিগেড সেনা যুদ্ধ করছে এবং সেখানকার যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু মধ্য গাজার স্থলযুদ্ধ এখন পর্যন্ত আল-বুরেজ শরণার্থী শিবিরের পূর্ব সীমান্তই অতিক্রম করেনি। ইসরায়েলি বাহিনীর কয়েকটি ব্রিগেড একসঙ্গে চেষ্টা করেও মাত্র কয়েক বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট একটি এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
নুসিরাত, মাগাজি কিংবা দেইরাল বালাহ এলাকায় এখনও সংঘর্ষ শুরুই হয়নি। অথচ এই তিনটি শরণার্থী শিবিরে ৭ অক্টোবর থেকে অবিরাম বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে ইসরায়েলি সেনারা। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় ইসরায়েলের সাতটি ব্রিগেড যুদ্ধ করে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তারা উল্লেখযোগ্য কোনও সাফল্য পেয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
এটি কি সেই কথিত তৃতীয় পর্যায়ের যুদ্ধ শুরুর ইঙ্গিত?
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলি গণমাধ্যম দাবি করে আসছে যে, শিগগিরই গাজা যুদ্ধের তৃতীয় পর্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। কিন্তু তৃতীয় পর্যায় শুরু হতে যাওয়ার অর্থ মোটেও একথা নয় যে, প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধে ইসরায়েল বিজয়ী হয়েছে; যদিও তেল আবিব সেরকম কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করছে। ইসরায়েল মূলত একের পর এক পর্যায়ের কথা বলে জনমনে এমন ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে যে, যুদ্ধ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে।
কিন্তু সত্যিই কি যুদ্ধ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে?
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মূল সমস্যা হচ্ছে, তেল আবিব হামাসকে ধ্বংস করে গাজা পুনর্দখলের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যুদ্ধ শুরুর দিন থেকে সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের মতো কোনও সুস্পষ্ট সামরিক পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
শনিবার ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘আরও বহু মাস’ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু তার ওই ঘোষণার পরদিন অন্তত ১৫ হাজার সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, ইসরায়েলি জনগণকে বোকা বানানো ছাড়া তার ওই অঙ্গীকারের অন্য কোনও অর্থ হয় না।
ইসরায়েলি বার্তা সংস্থা ওয়ালা নিউজ জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে গাজা থেকে আরেও সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা আসতে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ নামকাওয়াস্ত সংঘাতে পরিণত হবে।
তাহলে কি যুদ্ধে হেরে গেছে ইসরায়েল?
আরব-ইসরাইল সংঘাতের ইতিহাসে গাজায় নজিরবিহীন প্রতিরোধের মুখে পড়েছে তেল আবিব। এ অবস্থায় সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাকে ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা গেলেও এখনও এ বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে, ইহুদিবাদীরা কি গাজা থেকে পুরোপুরি সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাকি এখনও যেনতেন একটি জয়ের আশা তারা করছে।
কোনও কোনও ইসরাইলি গণমাধ্যম চতুর্থ পর্যায়ের যুদ্ধের কথা বলার চেষ্টা করছে। ওই পর্যায়ে গাজা উপত্যকা পুরোপুরি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসার কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পরাজিত করতে না পারে তাহলে তারা কীভাবে গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে?
ফিলিস্তিনিরা কি তাহলে জিততে যাচ্ছে?
‘বারজিলাই মেডিক্যাল সেন্টার’ নামক একটি ইসরায়েলি হাসপাতাল রবিবার জানিয়েছে, তারা ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৩,৫০০ আহত ইসরায়েলি সেনার চিকিৎসা করেছে। এই এক হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণকারী এত বেশি সেনা ইসরায়েলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে কখনও আহত হয়নি; যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এই পরিসংখ্যান কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি।
কাজেই গাজায় ইসরায়েল পরাজিত হতে যাচ্ছে এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা বিজয়ী হতে যাচ্ছেন- এটি বলা ছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতিকে অন্য কোনও ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে গাজা থেকে বিপুল সংখ্যক ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার করাকে কোন অবস্থায়ই অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই।