জাতিসংঘ সম্মেলনের সাইড ইভেন্ট: একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি পুনর্ব্যক্ত
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১২ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৫৪:০২ অপরাহ্ন
আনসার আহমেদ উল্লাহ: জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চলমান ৫৪তম অধিবেশনের সাইড ইভেন্টে বক্তারা সরকার, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত বাংলাদেশের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, নীরবতার অর্থই প্রশ্রয়। তাই প্রতিটি গণহত্যা, প্রতিটি যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ স্বীকৃতি, ভুক্তভোগী, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা ও সম্মান দেওয়া এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি বন্ধের পূর্বশর্ত। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়িত্ব ও ভূমিকা রয়েছে বলেও তাঁরা উল্লেখ করেন।
ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম এবং গ্লোবাল সলিডারিটি ফর পিস-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘ন্যায়বিচার এবং শান্তি: বাংলাদেশে গণহত্যা ১৯৭১’ শীর্ষক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। ১০ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ ভবনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সহায়তা করেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন, সুইজারল্যান্ড এবং বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ (বাসুগ)। বাসুগ চেয়ারম্যান বিকাশ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জেনেভায় জাতিসংঘ অফিস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ সফিউর রহমান।
সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ডাচ পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য হ্যারি ভ্যান বোমেল, ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং ইইউ টুডে-এর প্রকাশক গ্যারি কার্টরাইট, নেদারল্যান্ডসের লাইডেন ইউনিভার্সিটির গভর্ন্যান্স অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স অনুষদের প্রভাষক এবং পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত গবেষক আলিনা খান, বন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক ড. হোসাইন আবদুল হাই, বেলুচ ভয়েস অ্যাসোসিয়েশনের ফ্রান্স এর সভাপতি মুনির মেঙ্গল, ইউনাইটেড কাশ্মীর পিপলস ন্যাশনাল পার্টির নির্বাসিত চেয়ারম্যান সরদার শওকত আলী কাশ্মীরি, বেলজিয়ামস্থ গ্লোবাল সলিডারিটির সভাপতি মোর্শেদ মাহমুদ, ইউরোপীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মিয়া আবুল কালাম এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ, সুইজারল্যান্ডের সভাপতি খলিলুর রহমান মামুন।
বক্তারা বাংলাদেশের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময় উল্লেখ করে বলেন, স্বীকৃতির মাধ্যমে একাত্তরের গণহত্যার শিকার ও তাদের বংশধরদের সম্মান জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একান্ত প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের গণহত্যা আজ ইতিহাসের একটি বিস্মৃত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের সংস্থাসমূহে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ সফিউর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার একটি জাতিকে নির্মূল করতে চেয়েছিল। তাই শুরু থেকেই তারা তৎকালীন পূর্বাংশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চেষ্টা করতে থাকে। তারা বাঙালি সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়কে ধ্বংস করতে বাংলা ভাষার উপর হামলা সহ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে শোষণ ও বঞ্চনার কৌশল গ্রহণ করে।
সত্তরের নির্বাচন পরবর্তী প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। তারই ফলশ্রুতিতে গোটা জাতি তাঁকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছিল। কিন্তু তাঁকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি। বাঙ্গালীরা সরকার চালাতে সক্ষম নয় এমন অজুহাত তুলে পাকিস্তানি সরকার বাঙ্গালী জাতির উপর নির্যাতন শুরু করে। তারা অপারেশন সার্চলাইটের নামে সারা বাংলায় বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এমনকি বাঙ্গালী জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে তারা বিজয় অর্জনের দ্বারপ্রান্তে বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদের একে একে হত্যা করতে থাকে।
ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং ইইউ টুডে-র প্রকাশক গ্যারি কার্টরাইট বলেন, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল এবং বাংলাদেশী জনগণের স্বাধিকারের প্রত্যাশাও বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। তবে পাকিস্তান এখনও ব্লাসফেমি আইন নিয়ে পড়ে রয়েছে, যেটার কড়া সমালোচক আমি, কারণ সেটা সেই বিগত শতকের বিষয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে বহুদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের জিডিপি এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও বেশি। মাত্র পাঁচ দশক আগে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের জন্য এটি একটি অবিশ্বাস্য সাফল্য।
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান এবং নেদারল্যান্ডের লাইডেন ইউনিভার্সিটির গভর্ন্যান্স অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স অনুষদের লেকচারার আলিনা খান বলেছেন, ‘এটা আমার পক্ষে বোধগম্য হয় না যে, পাকিস্তান সরকার এবং সমাজ কিভাবে সম্পূর্ণরূপে সেই ইতিহাস মুছে ফেলার প্রত্যাশা করতে পারে, যে ঘটনায় একটি গোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নিধন করা হয়েছিল। আমি এটা জানি যে, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত একজন আমেরিকান হিসেবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি, অন্য যে কোন পাকিস্তানি ব্যক্তির থেকে ভিন্ন হতে পারে। যাহোক, আমি মনে করি না যে এটি গুরুত্বপূর্ণ। বরং আমি মনে করি, এবিষয়ে সংলাপ শুরু করার জন্য সব পাকিস্তানিদের সচেষ্ট হতে হবে। আমি মনে করি না যে, সমন্বিত ইতিহাস এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া ন্যায়বিচারে পৌঁছানো সম্ভব।
জার্মানির আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সংস্থা ডয়েচে ভেলে এর সাবেক সাংবাদিক এবং জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ হোসাইন আব্দুল হাই তাঁর গবেষণাপত্রে বলেছেন, একাত্তর মানব ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় বর্বরতা শুধুমাত্র সৈন্য, যোদ্ধা বা একটি সম্প্রদায়ের একক কোন গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা একটি গোটা জাতি ও জাতিসত্তার ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও ও নির্মূলের প্রমাণ রেখে গেছে। যুদ্ধের সময় নারী ও শিশুরা প্রায়ই সহিংসতার, বিশেষ করে যৌন সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ৫২ বছর আগে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে এবং তাদের বাঙ্কারের আঁধারে নির্যাতনের শিকার অসহায় মা-বোনের আর্তনাদ পৃথিবীর মানুষের কানে না পৌঁছলেও, বর্তমানে জীবিত বীর বঙ্গমাতা বীরাঙ্গনাদের লোমহর্ষক বর্ণনা যখন বর্তমান বিশ্ব মোড়লদের সম্মুখে জীবন্ত দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তখন কোন মানবসমাজ এই গণহত্যার স্বীকৃতি না দিয়ে বসে থাকতে পারে না।