মায়া ছাড়া কোনো প্রকার জয়ধ্বনি নেই
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ৫:৪৪:৪৩ অপরাহ্ন
সারওয়ার চৌধুরী
ডিজিটাল বিপণন কৌশলবিদ, ‘ওয়ান মিলিয়ন ফলোয়ার্স’ গ্রন্থের লেখক ব্রেনডান কেইন সোজা বললেন- ‘মন স্পর্শ করে এমন কনটেন্ট তৈরি করুন। বিষয়বস্তু তৈরি করার সময় আরেকটি প্রশ্ন আপনার সবসময় নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, ‘এই বিষয়বস্তু কি দর্শক/পাঠক/গ্রাহককে মায়ায় জড়াতে পারবে? যে কোন বিষয়বস্তু কেউ মূল্যবান মনে করলে তাকে মায়ায় জড়াতে পারে। বিষয়বস্তু তৈরির সময় ভাবুন- এটা মানুষকে হাসাতে কাঁদাতে রাগাতে বা উৎসাহিত করতে পারবে কিনা। মানে মানুষের সাড়া পাওয়ার মতো কী আছে এতে। মন স্পর্শ করে এমন বার্তা/বিষয়বস্তু/পণ্য মানুষ শেয়ার করে।’
দেখা যাচ্ছে ‘বিজ্ঞানের অবদান’ ডিজিটাল মার্কেটিং দুনিয়ায় মন স্পর্শের হিসাব গুরুত্বসহকারে নিতে হচ্ছে। মানে, বুদ্ধি যা দিল বের করে, তা সফল হওয়ার জন্যে মায়ার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। সেটা কি বুদ্ধি আর মায়ার পারস্পরিক সংযোগ বা শেয়ারিং? নাকি দুই পক্ষের পারস্পরিক নির্ভরতা?
শেয়ার করলে কি হয়? সহজ উত্তর- কেয়ার করা হয়। কেয়ার মানে যত্ন। যত্ন অন্তর দিয়ে হলে কেল্লা ফতেহ, মানে বিজয় নিশ্চিত। অনলাইন জায়ান্ট কোম্পানি ‘শেয়ারেবিলিটি’ একটি ব্রান্ড এজেন্সি। বিলিয়ন-বিলিয়ন মানুষের সাথে সংযোগ এ কোম্পানির। তারা শেয়ার বাড়ানোর বুদ্ধি বাৎলে দেয়। শেয়ারেবিলিটি জানে যে বিজ্ঞাপন শুধুমাত্র আবেগপূর্ণ সংযোগ তৈরি করতে পারলে গ্রাহক/পাঠক/দর্শকের সাথে দৃঢ় বন্ধন তৈরি করতে পারে। আর তা মানুষ সানন্দে শেয়ার করে নতুন সম্পর্ক তৈরি করে। ‘শেয়ারেবিলিটি’ সহপ্রতিষ্ঠাতা ও চিফ স্ট্রাটেজি অফিসার এরিক ব্রাউনস্টেইন বললেন- ‘লোকেরা যখন শেয়ার করেন তখন তারা কেয়ার করেন এবং যখন তারা কেয়ার নেন তারা আপনার পণ্য কেনেন।’ ভাল কেয়ার নিতে হলে আবেগ ও অনুভূতি থাকতে হয়। আন্তরিক থাকতে হয়। অন্তরের ব্যাপার-স্যাপার আবেগ ছাড়া হয় না। তার মানে আবেগের জয়ধ্বনি ঠিক না, আবেগের ভান্ডার থেকে আসা খাঁটি মায়ার জয়ধ্বনি সর্বত্র। মায়া কেবল গরীব দেশগুলোতে না। ‘উন্নত’ দেশগুলোতে মায়ার ইতিহাস জ্বলজ্বলে। ‘উন্নত’ দেশের নাগরিক ব্রেনডান কেইন-ই তো বললেন কনটেন্ট মন ছুুঁতে না পারলে, মায়ায় জড়াতে না পারলে সফলতা আসে না। তার গবেষণায় অন্তর গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তরের সাথে সংযুক্ত হতে হলে আন্তরিক হতে হয়। সেটা কৃত্রিমভাবে করলে হয় না। টাকা খরচ করে কোনো ‘ডক্টর’-র অযথা প্রশংসা আদায় করলে কেউ কালজয়ী মেধাবী হয়ে যায় না। আমড়া কাঠের ঢেঁকি বানানো যায় কিন্তু ওই ঢেঁকি দিয়ে চাল কুটা যায় না। কেবল রাজনৈতিক চালবাজি করলে অবশেষে বঞ্চিত হতে হয়। তাই দেখা যায় অনেক রাজনীতিক ‘অনেক কিছু করেও’ গণমানুষের হৃদয়ে স্থান পান না। খুব তাড়াতাড়ি বিস্মৃত হন। রাজনীতিক উৎসুক জনতার মায়া ধরতে না পারলে ব্যর্থ হতে হয়। কেননা উৎসুক জনতা খাঁটি মায়ার কাঙাল। তাদের কাছে ‘সভ্যতার ভণ্ডামি’ নেই।
আবার একটু যাওয়া যাক ব্রেনডান কেইনের কাছে। তিনি বললেন- ‘আপনি যখন নিজের কাছে সৎ আর নিজের প্রতি মনোযোগী থাকেন, তখন অন্যরা সহজে আপনার সাথে সংযুক্ত হতে পারেন।’ কেননা অন্তরের কাজে সততা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিমতা সেখানে প্রবেশ নিষেধ। নিজের কাছে সৎ থাকলে নিজেকে জানতে পারার দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। নিজেকে জানা ব্যাপারটা কী? একটা জানা এরকম যে, প্রত্যেকে তার মাঝে যেসব গুণ আছে, তার কাজ করার ক্ষমতা আছে তা বুঝে নিতে পারা। এই জানা এমন যে মানুষটির ঘনিষ্ঠ কেউ, মা বাবা নিশ্চিত কিছু বলতে পারবেন না তার নিজের এই জানা সম্পর্কে, যতটুকু আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে তার নিজের কাজের ক্ষমতা বোঝেন, অন্য কেউ অতো নিশ্চিত হতে পারে না। আবার নিজে অধিক জানার পরেও সে যা দেখতে পারছে তার মাঝে আছে, মানে ক্ষমতার ব্যাপারটাই, মানে ষোলআনা নিশ্চিত হয়েও সে তার গুণের ব্যাপারে কখনও এমনও হয়, সে সন্দিহান, সে দ্বিধাতে — সে পারবে কিনা নিশ্চিত না। এখানে সে তার ‘চেনা-জানা’ নিজের ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য ষোলআনা চিনতে পারছে না। তার মানে সে তার কনশাসনেস-কে চিনতে পারছে না? কখনও বাস্তবতা তার সামনে এভাবে আসে যে, কাজটির ফল কী হবে সুনিশ্চিতভাবে বুঝতে না পেরেই তাকে কাজটি করে ফেলতে হয়। সে বলে, ‘অন্য উপায় খুঁজে পাইতেছিলাম না, এইটা ঠিক হবে কিনা নিশ্চিত হওয়ার আগেই করে ফেলতে হয়েছে।’
কেইন জানালেন- ‘বর্তমান সময়ের সেরা ফেসবুক কন্টেন্ট জিনিয়াসদের একজন হলেন প্রিন্স ইএ। তিনি কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেন গ্রাহকসেবা। তিনি স্বীকার করেন যে যদিও তার অহং ( প্রায়শই হয়) লক্ষ লক্ষ ভিউ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার সাথে জড়িত। কিন্তু তিনি সর্বদা মূল লক্ষ্যে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মূল লক্ষ্য হলো ফলোয়ারদের হৃদয়ে পৌঁছে যাওয়া। মানে ভাল সেবা দেওয়া। তিনি কনটেন্ট তৈরি করেন মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে এমন কিছু। প্রিন্স ইএ বিশ্বাস করেন যে যদিও একটি ভিডিওর শিরোনাম, থাম্বনেইল, দৈর্ঘ্য, এবং প্রথম কয়েক সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ। তবে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন কনটেন্ট মানুষের মনে দোলা না দিলে আসল কাজ হবে না।’
মন দোলে আবেগে। হ্যাঁ, মন ও আবেগ দুইই অধরা – আধ্যাত্মিক এই অধরা বস্তু, সীমিত অর্থে। আত্মা হতে আগত বিষয়ক না। (আধ্যাত্মিকতা অন্য জিনিস, যদিও এর সাথে দূরতম সম্পর্ক আছে।) প্রভাবশালী মন যা মানুষ চিহ্নিত করে সেই মনে থাকে প্রভাবশালী মায়া। মায়া বের হয় ম্যাটার থেকে। ম্যাটারের ভিতর থাকে স্পিরিট বা চেতনা। চেতনাকে সাজায় বা জেনারেট করে ইলেক্ট্রন নিউট্রন প্রোটন। এ রকম একটা বিশ্লেষণ আছে। থাকতেই পারে। অন্যদিকে এটা তো দেখাই যায়- জগতের সব প্রভাবশালী ঘটনা/সৃজন গভীর মায়াজাত। চিন্তাবিদের চিন্তাটি আবেগঘন হওয়ার পরেই প্রভাব সঞ্চার করে। সৃজন পালন ধ্বংসে প্রবল আবেগ ক্রিয়াশীল। আবেগ ছাড়া বেগ আসে না। জোনাহ বার্গারের ২০১৩ সালের বই কনটেইজিয়াস (সংক্রামক), এতে মনোবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী মানুষের মন কীভাবে প্রভাবিত হয় এর ব্যাখ্যা আছে। বোঝানো হয়েছে মানুষের আচরণ কীভাবে আকৃষ্ট হয় – কেন মানুষ উৎসাহিত হয় অন্যের বার্তা/বই/কনটেন্ট/বিষয়বস্তু শেয়ার করতে। তাতে দেখানো হয়েছে কেন মানুষ সমাজে প্রচলিত ধারনা শেয়ার করে থাকে। তারা ভাবে- এটা শেয়ার করা স্মার্ট মানুষের কাজ – এতে মানুষকে সাহায্য করা হয়। কারো কাছে কোনো নতুন বার্তা পৌঁছে দেওয়ার আনন্দ পেতে চায় মানুষ।
হালিম বয়াতির গান- ‘তুমি এমন করে ছেড়ে যাইবা দয়াল’ কিংবা জেইন টেইলরের ক্লাসিক গান ‘টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার’, অথবা ফকির লালন শাহ, হাছন রাজার গান, কিংবা আবুল হাসানের কবিতাগুলো মন স্পর্শের পাঠবস্তু। জীবনানন্দ, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, কিটস, ইয়েটস, বায়রন, শেলি, শেক্সপিয়র, এলিয়ট, ওয়াল্ট হুইটম্যান প্রমুখ এই লাইনের – এই ধারার সকলে শীর্ষে এসেছেন ক্লাসিক মায়া চর্চা করে। ক্লাসিক মায়া থেকে জনম নেয় ক্লাসিক শিল্প। মূল্যবান জিনিস ক্লাসিক অমূল্য ধন মায়াতে জড়ায়। তবে, ফেইক-ফালতু অতঃপর দিন শেষে ফেইক-ফালতু চিহ্নিত হয়।
পি বি শেলি লিখেছিলেন একটি অসাধারণ কবিতা ‘টু এ্যা স্কাইলার্ক’, যে-কবিতার ভিতরের একটি সহজ সরল পংক্তি- Our sweetest songs are those that tell of saddest thought. কি দারুন সত্য বেরিয়ে এলো সুগভীর মনোযোগ আর আন্তরিক পর্যবেক্ষণ থেকে। দুঃখভারাক্রান্ত হওয়া থেকে প্রস্ফুটিত হয় সুইটেস্ট সঙ। যে জানে সে বুঝে দুঃখও একটি অনন্য রস।
তারা বলেন স্কাইলার্ক, আমরা বলি ভরত পাখি। পাখিবিশারদ শরিফ খান চমৎকার করে আমাদের জানালেন এই ভরত পাখি সম্পর্কে- ‘বোশেখের বিকেলে এই পাখি যে সুমধুর গান গাইতে গাইতে ওপরে উঠল ও নামল, তার কারণ, ওটার বুকভরা এখন ম–ম ভালোবাসা, প্রেমিকা তো মাঠের ভেতরে ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে। ‘কত ভালোবাসি তোমাকে’ দেখানোর জন্যই তো নৃত্যগীতের এতটা কসরত।’ এই পাখির মায়াভরা হরকত – মনোমুগ্ধকর নৃত্যগীত – কবির মনকে প্রভাবিত করল, কবির মন মনন অনিন্দ্য অনুভবে আচ্ছাদিত হয়ে সৃষ্টি হল কালজয়ী ‘টু এ্যা স্কাইলার্ক’।
মন কেন অন্য মনের মায়াতে সাড়া দেয়? বিজ্ঞান কী দেখায়? হেলথকেয়ার প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে Beth A. Lown জানালেন- ‘Advances in neuroscience have shown us that the human brain has neural networks that are hard-wired with the ability to share the experiences of others, including emotions and sensations.’ (বাংলা অনুবাদ: নিউরোসায়েন্সের অগ্রগতি আমাদের দেখিয়েছে, মানুষের মস্তিষ্কে এমন নিউরাল নেটওয়ার্ক রয়েছে যা অন্যের আবেগ অনুভবের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার ক্ষমতাসম্পন্ন।)
একটা প্রশ্ন এমন তো করা যায়- খাঁটি মায়ার জয়ধ্বনি সর্বত্র কী কারণে? সহজ উত্তর- খাঁটি মায়া মানুষকে খাঁটি মানুষ বানায়। খাঁটি মানুষ জীবনে চলার পথে ভুল-ত্রুটিসহ চলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি সচেতন থাকেন হৃদয়জাত নিয়ম-নীতির ব্যাপারে। হৃদয় আকৃষ্ট হয় Laws of the heart বা হৃদয়ের নিয়ামবলীর নিয়মে। এই সূত্রসমূহ ফ্রাংক-স্টারলিং-এর বায়োলজিক্যাল ম্যাকানিজম বিষয়ক নয়।
ওদিকে শামস তাবরিজি জানিয়ে গেলেন- ‘মায়ার কোনো নাম-আখ্যা নেই, সংগা নেই। মায়া শুধু মায়া, বিশুদ্ধ এবং সহজ। মায়া জীবনের পানি। আর আশেক হয়ে ওঠেন অগ্নিআত্মা। মহাবিশ্ব অন্যরকম হয় যখন আগুন ভালোবাসে পানি।’ মন স্পর্শের কাজ হয় মায়াভরা, অনিন্দ্য, কার্যকর – সফল।
সারওয়ার চৌধুরী: কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, নির্বাহী সম্পাদক, অনুপমনিউজটোয়েন্টিফোর