আকর্ষণীয় সংবাদের উপকার আর দুষ্টের অসাধারণ কীর্তি
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মার্চ ২০২৩, ৭:০৮:০২ অপরাহ্ন
সারওয়ার চৌধুরী
সাধারণ অর্থে সব মানুষ ভোক্তা ক্রেতা। বিক্রেতাও ক্রেতা, বিক্রেতাও ভোক্তা। সকলেই ইউজার – কাস্টমার – কনজিউমার। ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন অর্থ সেটা তো থাকছেই। তাদের নানা শ্রেণীও আছে বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে। সবাই সবকিছু খায় না, নেয় না, নিতে পারে না, বুঝতে পারে না; সরাসরি সকলের সবকিছুর প্রয়োজনও নেই।
গোড়া থেকে দেখলে ‘নিউজ’ শব্দটি প্লুরাল নাউন। ‘new’ এর news। কিন্তু কালক্রমে এ বহুবচনের ‘নিউজ’ শব্দটি হয়ে উঠল এক বচন বিশেষ্য – সিঙ্গুলার নন-কাউন্টেবল নাউন। সংবাদপত্র বিশেষজ্ঞগণ আমাদেরকে বুঝিয়ে দেন- নিউজ হল তা, যা হয়ে উঠে নোটওয়ার্দি, মানে যাকিছু উল্লেখযোগ্য বা লক্ষণীয় বা দ্রষ্টব্য, কিংবা ডিজিটাল এ যুগে বলা যায় যাকিছু শেয়ার করার যোগ্য তা নিউজ। মানে নিউজ তা-ই যা নিউজওয়ার্দি মানে সহজ বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ নতুন খবর।
তবে আরেকটু গভীরভাবে দেখলে The word news means exactly that – things which are new. মানে সহজ কথায়- নতুন গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়েছে ঘটেছে এসেছে সমাজ বাস্তবতায় তা ‘নিউজ’। কিন্তু ‘সভ্য’ মানুষ ইতোমধ্যে খুব ‘চালাক’ হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু না ঘটলেও, নানা ছল-ছুতায় খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে এমন সংবাদ রচনা করে তা সংবাদমাধ্যমে প্রচার করে। ইতিহাসের সেই ‘হলুদ বালক’ কিংবা ‘জার্নাল’ আর ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ দুর্দান্ত ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশের প্রতিযোগিতা থেকে অতঃপর যে ইতিহাস তৈরি হলো, তা বিস্ময়কর বটে। আমরা সে বয়ানে ঢুকব কিছুক্ষণ পরে। ছোট্ট কিংবা বিশাল, পৃথিবীতে ‘বাজে ইতিহাস’ থেকে ‘অসাধারণ ইতিহাস’ হয়ে যাওয়া থেমে নেই। প্রকৃতিতে বিষাক্ত প্রাণীটিও উপকার ও অপকার দুইই করে মারা যাচ্ছে। ক্ষতি যা করছে তা দেখা যাওয়া সত্বেও তার কার্যক্রমে উপকার না অপকারের পাল্লা ভারি তা গবেষণা করে দেখার বিষয়। মানুষ জানতে পেরেছে- বিষাক্তের বিষ থেকে হয় প্রাণ রক্ষার ওষুধ। তাছাড়া মন্দ কাজের দ্বারা ভাল কাজ করার দৃষ্টান্ত তো প্রায় প্রতিটি সমাজে আছে। প্রিয় সন্তানকে শাসনে রাখতে হয়, কখনো শাস্তি দিতে হয় তাকে মারাত্মক ক্ষতি থেকে বাঁচাতে।
মানুষ তো প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কখনো মিথ্যা কথা বলেই ঘরে বাইরে। মিথ্যা একটি ‘সত্য’ জগত বাস্তবতায়। মানুষ ঢং করতে মিথ্যা বলে। বিষয়বস্তুকে রঙিন করতে মিথ্যা বলে। কোনোএকটা লক্ষ্যে পৌঁছতে ‘কৌশল’ প্রয়োগ করতে মিথ্যা বলে। দেখা গেছে মিথ্যা বলার পেছনে উদ্দেশ্য থাকে। মানুষ নাকি ‘ভাল কিছু’ করার জন্যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। মিথ্যাকে বলা হয় অন্ধকার, সত্যকে আলো। কিন্তু প্রশ্ন থাকে মিথ্যা যখন সত্য আকারে বাস্তবতায় থাকে, তখন সেটা কি আলো হয়? জটিল হিসাব বটে। হ্যাঁ, সংবাদপত্রের জগতে ‘সত্য’র জন্যে মিথ্যা বলাকে The Ethics of deceptive journalism ট্যাগ করা হয়েছে। রাজনীতিতে মিথ্যা ‘অলংকার’ হিসাবে সমাদৃত। রাজনীতিকদের কাছে আছে ‘মার্জিত মিথ্যাচার’।
ওদিকে, কোনো চ্যালেঞ্জার এগিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘ইটিং দি বিগ ফিশ’ গ্রন্থের লেখক এ্যাডাম মরগ্যান মানবজাতিকে জানালেন – ‘‘নিউইয়র্ক পোস্টের একজন প্রাক্তন সম্পাদক এক তরুণ ছাত্রকে বলেছেন এভাবে-
আপনাকে কিছু বলি, শুনুন। পাঠকের গলা টিপে ধরতে হবে। সে ট্রেনে আছে। গরমকাল এখন। তার পাশের লোকটি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ভিড় সেখানে। মাথা গরম হয়ে লোকটা কিছু করে বসতে পারে। আপনার সংবাদের শিরোনাম তাৎক্ষণিক লোকটাকে টেনে ধরতে পারে। ধরুন, কোনো পাঠক তার সেক্রেটারিকে আঘাত করার চেষ্টা করছে; কিংবা এক ভদ্রলোকের উপর তার স্ত্রী ক্ষুব্ধ, উনি তাকে দিনে সময় দেন না একটুও। তার বাচ্চার ব্রেসিস দরকার; তার কাছে টাকা নেই। এমন পরিস্থিতিতে আপনি কি চান এইসব পাঠকদের কেউ আপনার প্রতিবেদনটা পড়ুক? তাহলে আপনি এটাকে আরও আকর্ষণীয়/মনোগ্রাহী- যা মন টেনে ধরবে, সেভাবে লিখে নেন।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
মরগ্যান বোঝালেন, ‘আসলে চ্যালেঞ্জারদেরকে তাদের সবকিছুতে সাহসী অবস্থান নিতে হবে’। তাই মনোগ্রাহী শিরোনামে মনোহর প্রতিবেদন দরকার। ভিত্তি আছে নাকি ভিত্তিহীন সেটা এই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনায় নেওয়ার না। চ্যালেঞ্জার হলেন উচ্চাকাঙ্খী। সে শীর্ষে পৌঁছতে চায়। এ্যাডাম মরগ্যান এটাও বললেন, ‘ভোক্তা এবং সংবাদপত্র প্রতিনিয়ত নতুনত্বের জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাচ্ছে। এই দুটির সমন্বয়ের মাঝে উচ্চাকাঙ্ক্ষী চ্যালেঞ্জার ব্র্যান্ডগুলোর জন্য বিশাল সুযোগ রয়েছে’৷
সংবাদপত্র জগতে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটি বলা যায় জোসেফ পুলিৎজার নামের একজন চ্যালেঞ্জারের ইতিহাসের অংশ বিশেষ; তার শীর্ষস্থানীয় ধনবান হয়ে ওঠার ইতিহাস; বিখ্যাত পুলিৎজার পুরস্কার প্রবর্তকের বেপরোয়া কর্মযজ্ঞের ইতিহাস।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের কথা। দুই বিখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্ট এক অশুভ অন্যায্য প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন, যার ফসল ‘হলুদ সাংবাদিকতা’। আবার এই পথে এগিয়ে যেতে যেতে এসেছে বিখ্যাত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, এসেছে পুলিৎজার পুরস্কার পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে।
এবার সেই ইতিহাস থেকে কিছুটা পাঠ করা যাক। ১৮৮৩ সালে ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংবাদপত্র কিনেছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার। সেই সংবাদপত্রের আগের মালিক ছিলেন জে গোল্ড। অন্যদিকে উইলিয়াম হার্স্ট ১৮৮২ সালে ‘দ্য জার্নাল’ নামে একটা পত্রিকা কিনে নিয়েছিলেন জোসেফ পুলিৎজারের ভাই অ্যালবার্ট পুলিৎজারের কাছ থেকে। কিন্তু জানা গেল পরিবারের সদস্যের পত্রিকা হার্স্টের হাতে চলে যাওয়া ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারছিলেন না পুলিৎজার।
ফলে শুরু হল হার্স্টের সাথে পুলিৎজারের স্নায়ুযুদ্ধ। পুলিৎজার ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ কিনেই কোমর বেঁধে লাগলেন চাঞ্চল্যকর খবর, চটকদারি সংবাদ ইত্যাদি প্রকাশ করা। একজন কার্টুনিস্ট রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট নামে। তাকে চাকরি দিলেন তার পত্রিকায়। ওই কার্টুনিস্ট ‘ইয়েলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে প্রতিদিন ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’-র প্রথম পাতায় একটি কার্টুন এঁকে দিতেন। তার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতি থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছু বলিয়ে নিতেন, যা ছিল পক্ষপাতদুষ্ট অনেকটাই। বস্তুনিষ্ঠতা থাকত না তাতে।
এক সময় হার্স্ট পুলিৎজারের ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’-র কার্টুনিস্ট ফেন্টোকে অধিক বেতনের প্রলোভন দিয়ে নিয়ে এলেন তার ‘জার্নাল’ পত্রিকাটিতে। হার্স্ট তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি, মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড-র ভালো সব সাংবাদিককেও টেনে নেন নিজের পত্রিকায়। পুলিৎজারের তো মাথা খারাপ অবস্থা। রেগেমেগে আগুন। তিনি অতঃপর পেয়ে যান জর্জ চি লুকস নামে আরেক কাটুনিস্টকে।
একদিকে ‘জার্নাল’, অন্যদিকে ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’। দুটো পত্রিকাতেই ছাপা হতে লাগলো ইয়েলো কিডস বা হলুদ বালক কার্টুন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল পত্রিকার কাটতি নিয়ে দুটো পত্রিকার মধ্যে লড়াই। ‘জার্নাল’ ভার্সাস ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’র বিরোধ সে সময়কার সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে গেল। দুই পত্রিকাই তাদের কাটতি বাড়ানোর জন্য ভিত্তিহীন, অর্ধসত্য, সত্য কিংবা ব্যক্তিগত কেলেংকারির খবর ছাপানো শুরু করে দিল।
ফলে জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্ট এ দুই সাংবাদিক হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত হলেন এবং ইতিহাসে চিহ্নিত হলেন। কিন্তু কালক্রমে এ ধরনের বাজে ইতিহাস সৃষ্টিকারী পুলিৎজার অন্যতর ইতিহাস রচনার দিকে মাথা ঘামানো শুরু করলেন।
জোসেফ পুলিৎজার জন্মেছিলেন ১৮৪৭ সালের ১০ এপ্রিল। অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ থেকে ঊনবিংশ শতকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত তিনি ছিলেন একাধারে সফলতম লেখক ও সংবাদপত্র প্রকাশক। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির মাধ্যমে তার আয় করা বিপুল অর্থ ও ধন-সম্পদ তিনি দান করে গেছেন কলম্বিয়া স্কুল অব জার্নালিজমে। এখন ওটা বিখ্যাত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
পুলিৎজারের ইচ্ছে অনুযায়ী ১৯১১ সালের ২৯ অক্টোবর তার প্রয়াণের পর তার সম্মানার্থে পুলিৎজার পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। সাংবাদিকতা ও আলোকচিত্রকলা, নাটক, কবিতা, ইতিহাস, পত্র, সংগীতের মতো ২১টি বিভাগে এ পুরস্কার সাংবার্ষিক আকারে দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, হলুদ সাংবাদিকতার সাথে তার নাম জড়িত থাকলেও ১৮৮০-এর দশকে পুলিৎজার নতুন সাংবাদিকতার কলা-কৌশল প্রবর্তন করে সংবাদপত্র পাঠকদের চমৎকৃত করেন। এ কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
জোসেফ পুলিৎজার
আমেরিকান সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার ১৮৪৭ সালের ১০ এপ্রিল যে দেশটিতে জন্মেছিলেন, সে-দেশটির নাম হাঙ্গেরী। ১৮৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে আসা পুলিৎজার ১৮৬৭ সালে সে দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে ফার্স্ট নিউইয়র্ক ক্যাভার্লিতে সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। একই বছর তিনি মিসৌরীর সেন্ট লুইসে অবস্থিত জার্মানভিত্তিক দৈনিক সংবাদপত্র ওয়েস্টলিসে পোস্টের প্রতিবেদক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৭১ সালে তিনি সম্পাদকীয় পরিচালনার দায়িত্ব পান এবং দৈনিকটির একাংশের মালিকানা পেয়ে যান। ওখানে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সেন্ট লুইসের রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েন পুলিৎজার। আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী পুলিৎজার, ১৮৭২ সালে লিবারেল রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে হোরেস গ্রিলে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি ‘নিউইয়র্ক সান’ পত্রিকার সংবাদদাতাও ছিলেন।
মিসিসিপির সম্পদশালী পরিবারের মেয়ে ক্যাথরিন কেট ডেভিসকে বিয়ে করেন পুলিৎজার ৩১ বছর বয়সে। ১৮৮৩ সালে সম্পদশালী ব্যক্তিরূপে পুলিৎজার ৩ লাখ ৪৬ হজার ইউএস ডলারের বিনিময়ে জে গোল্ডের কাছ থেকে ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ কিনেছিলেন। তখন পত্রিকাটি প্রতি বছর গড়ে ৪০ হাজার ডলার লোকসান দিত। পত্রিকার প্রচার বাড়াতে পুলিৎজার কৌতূহলোদ্দীপক গল্প, রটনা এবং আবেগধর্মী বিষয় সম্বলিত আইটেম প্রকাশ শুরু করেন হার্স্টের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে। ফল দাঁড়ালো- তার নেতৃত্বে প্রচার সংখ্যা ১৫ হাজার থেকে গিয়ে পৌঁছল ৬ লাখে। নাম বদনাম সুনাম ধন-দৌলত আর অনন্য ইতিহাস সৃস্টির সুযোগ সব পেয়ে যান একজন জোসেফ পুলিৎজার।
সারওয়ার চৌধুরী: কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, নির্বাহী সম্পাদক-অনুপমনিউজটোয়েন্টিফোর