গুজব, ক্ষমতার লোভ, তাঁর মৃত্যুদণ্ড
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৪৯:১১ অপরাহ্ন
সারওয়ার চৌধুরী
বিস্ময়কর এটাও যে, তিনি নিজেকে নাই করে দিয়েছিলেন বলেই যেনবা, দুনিয়ার মানুষ তাঁকে জানে তাঁর বাবার নামে— ‘মনসুর হাল্লাজ’। তাঁর নামে না। মানে, বাবার নামে তিনি আছেন, তাঁর নিজের নামে বিশ্বসমাজে নেই।
তাঁর নাম হোসাইন বিন মনসুর আল হাল্লাজ। মানে তাঁর নাম হোসাইন। পিতার নাম মনসুর, গোত্রের নাম আল হাল্লাজ। বিশ্বের আধ্যাত্মিক চর্চার পরিমণ্ডলে সজ্জনেরা জানেন— মনসুর হাল্লাজ নামে।
মনসুর হাল্লাজ রাহিমাহুল্লাহ নিজেকে নাই করে দিলেন, ছোট করলেন, একেবারে আখেরি দরজার বিনয় প্রকাশ করলেন, একবিন্দু আত্মঅহংকার রাখলেন না। জানালেন— আল্লাহই একমাত্র সত্য, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য নাই। এ ছিল তাঁর সেই বিশেষ ভাষায় ‘আনা আল হক’ কথাটির ভিতরের মর্ম।
কিন্তু মৃত্যুদন্ডদাতারা ছিল ভাষার বাইরের স্তরের অর্থের পণ্ডিত। সেসব পণ্ডিতদের কথার ধরনে প্রায়শ অহং প্রকাশ পেতে দেখা যায়। মনসুল হাল্লাজকে যে কারণে ‘ধর্মদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, সে-সম্পর্কিত একটা দলিল নিচে-
”This is what is signified by the words Anā l-Ḥaqq, “I am God.” People imagine that it is a presumptuous claim, whereas it is really a presumptuous claim to say Ana ‘l-‘abd, “I am the slave of God”; and Anā l-Ḥaqq, “I am God” is an expression of great humility. The man who says Ana ‘l-‘abd, “I am the servant of God” affirms two existences, his own and God’s, but he that says Anā l-Ḥaqq, “I am God” has made himself non-existent and has given himself up and says “I am God”, that is, “I am naught, He is all; there is no being but God’s.” This is the extreme of humility and self-abasement.”
(Commenting on the famous expression of Mansur al-Hallaj, for which al-Hallaj was executed as a blasphemer, in The Mathnawí of Jalálu’ddín Rúmí, Vol. 4, part 7, edited by Reynold Alleyne Nicholson (1940) p. 248)
মৃত্যুদণ্ডের কারণ
মনসুর হাল্লাজ যে-দিনগুলোতে খোদা সম্পর্কিত তাঁর উপলব্ধির কথা কাব্য ভাষায় প্রকাশ করছিলেন, তখন ইরাক ইরানসহ বিস্তৃত অঞ্চল আব্বাসীয় বংশধারার শাসন চলছিল। তখন শিয়া সুন্নির বিরোধ তো ছিলই, সুন্নির ভিতরের হাম্বালি মাজহাবের অনুসারিদের সাথেও অন্যদের ঝগড়া ছিল।
ওদিকে সবচেয়ে ক্ষমতাধর আব্বাসীয় শাসকবংশের আল মুক্তাদিরকে শাসকের বয়স না হওয়া সত্বেও খলিফার দায়িত্ব দেয়ায় জনগণের মাঝে ক্ষোভ ছিল। একবার সরিয়ে আবার পূনর্বহাল করা হল।
এরিমাঝে কয়েকবার মনসুর হাল্লাজ হজ্ব করে আসেন। একবার ৪ শ অনুসারীসহ হজ্ব করেন। খোদার নৈকট্য পাওয়ার বিশেষ প্রার্থনা করেন। অথচ মুক্তাদিরের অনুসারীরা গুজব ছড়ায়— কাবা শরীফ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে এবং মুক্তাদির বিরোধীদের সাথে মনসুর হাল্লাজের সম্পর্ক আছে। অথচ তিনি ক্ষমতার লোভের ধারে-কাছে না থেকে গভীরভাবে খোদাকে বুঝবার পথে থাকছিলেন আর আধ্যাত্মিক অর্থসমৃদ্ধ কবিতা ও কথা বলছিলেন।
তারা তাদের গুজবের পক্ষে প্রচার করে মনসুর হাল্লাজের একটি কবিতাংশ, এর ইংরেজি হল— ‘the important thing is to proceed seven times around the Kaaba of one’s heart.’ মানে, ‘গুরুত্বপূর্ণ হল, কেউ তার হৃদয়ের কাবার চৌদিকে সাত বার প্রদক্ষিণ করা’।
খলিফার মা মধ্যস্থতা করে চেয়েছিলেন এ দরবেশ কবির মৃত্যুদণ্ড না হোক। কিন্তু উজিরের চক্রান্তে খলিফা মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে থাকেন। খলিফাকে বোঝানো হল, মনসুর হাল্লাজের অনুসারী দিনে দিনে বাড়ছে, এরা ধর্মীয় সংস্কার চান, এক সময় তাঁর অনুসারী বেড়ে গিয়ে আব্বাসীয় বংশধারার পতন ঘটাবে। ফলে স্বাভাবিকভাবে শাসকের ক্ষোভ প্রজ্বলিত হল।
এর আগে মনসুর হাল্লাজকে শাফেয়ী মাজহাবের বিচারকের কাছে নেয়া হয়েছিল তাঁর আধ্যাত্মিক কথাবার্তার বিচার করতে, যেসব কথা ধর্মবিরোধী মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। কিন্তু শাফেয়ী বিচারক বিচার করতে রাজি হন নি। তিনি কারণ বললেন— ‘mystic inspiration was beyond his jurisdiction.’ মানে, আধ্যাত্মিক প্রেরণা তাঁর আইনগত অধিকারের বাইরের বিষয়।’
তারও আগে এক শাফেয়ী জজ মনসুরের ‘খোদার সাথে একাত্ম’ হওয়ার কথা বলায় মাথা কামিয়ে, তলোয়ারের চেপ্টা অংশ দিয়ে বেত মারার মতো মেরে ছেড়ে দেন এবং জানান মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার অপরাধ তিনি করেন নি এবং তাঁর কথা ‘প্রুফ অব ডিসবিলিভ’ বা ‘অবিশ্বাসের প্রমাণ’ হয় না।
অবশেষে আব্বাসীয় আদালত ৯ বছর কারাগারে রেখে ৯২২ খৃষ্টাব্দের ২৬ মার্চ (এ্যানসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা) বাগদাদে টাইগ্রিস নদীপারে হাজার হাজার মানুষের সামনে দিনের বেলায় দরবেশ কবি মনসুর হাল্লাজের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। তাঁকে মুখে ঘুশি মারতে মারতে, লাঠি দিয়ে মারতে মারতে বেহুঁশ করে ফেলে। পরে শিরচ্ছেদ বা ফাঁসি দেয়। আগুনে জ্বালিয়ে ছাই ফেলে দেয়া হয় নদীতে।
তাঁর মৃত্যুভয় ছিল না, তিনিই বলতেন ‘মারো আমাকে।’ মৃত্যুপথযাত্রী তিনি টর্চারের সময় শান্ত অবিচলিত ছিলেন।