কর্মপ্রয়াসে এগিয়ে যাওয়া আনোয়ার শাহজাহান
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ নভেম্বর ২০২২, ৬:০৫:২৬ অপরাহ্ন
:: ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন ::
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ এক এলাকায় আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই নিজেদের এলাকা নিয়ে এই অহংকারের কথা জানতাম। ঔপনিবেশিক সময়ে সরকারে উচ্চপদে কতজন আছেন, কতজন সেনাবাহিনীতে আছেন এসব নিয়ে আলোচনা হতো। শিক্ষা, সংস্কৃতিতে আমাদের এলাকাটি খুবই উজ্জ্বল অবস্থানে ছিল।
সেই অগ্রসর জনপদে বেড়ে ওঠার সময়টি খুব দ্রুত চলে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী উত্তাল সময় আর আমাদের ক্ষোভ-দ্রোহের সময়ে দেশের নানা অঞ্চলকে পিছিয়ে পড়তেও দেখেছি। সিলেটের গোলাপগঞ্জে বড় হতে গিয়ে সফল মানুষের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তাঁদের ছায়াতলে আবার নতুন করে লোকজনের সফল হয়ে ওঠার বিষয়টা তেমনভাবে উঠে আসেনি।
একসময় ফিরে দেখতে গিয়ে লক্ষ করেছি, আমাদের পূর্বসূরিরা সমাজের নানা ক্ষেত্রে যেসব অবদান রেখেছেন, যাঁদের কর্মের আলোর বিভায় আমাদের বেড়ে ওঠা, তাঁদের তুলনায় আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বেলাভ‚মি গোলাপগঞ্জ। নদী, হাওর, পাহাড় ও টিলার এমন মিশ্র সৌন্দর্য বাংলাদেশের খুব কম এলাকায় দেখা যায়। পাহাড়ের লাল মাটির সাথে মিশে আছে উর্বর পলিমাটি। কঠিন শিলাপাথরের পাশেই অবারিত সবুজের মেলা। বৈচিত্র্যের এই উর্বর ভূমি বারবার জন্ম দিয়েছে আলোকিত মানুষের।
গোলাপগঞ্জের প্রতিটি গ্রামে গেলে দেখা পাওয়া যায় আলোকিত মানুষের পদচিহ্ন। একসময় আসাম, কাছাড়, করিমগঞ্জকেন্দ্রিক দাপটের সময় পেরিয়ে গোলাপগঞ্জের লোকজন তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রসর অবস্থানে ছিলেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার সময় পেরিয়ে পরাধীন পাকিস্তানের সময়ও এই পূর্ব বাংলার মধ্যে গোলাপগঞ্জ এগিয়ে থেকেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গোলাপগঞ্জের লোকজনের বীরত্বের কাহিনি কারও অজানা নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন এই এলাকার রাজনীতিবিদরা।
সিলেট অঞ্চলের রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে গোলাপগঞ্জের লোকজনের এগিয়ে থাকা ছিল আভিজাত্যের। এখানকার মানুষ যেমন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, তেমনি শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছেন। পূর্ব বাংলার ইতিহাসে ‘নানকার বিদ্রোহ’ নামক আন্দোলনের স্মৃতিধন্য গোলাপগঞ্জ এলাকা। ইতিহাসের গভীর পাঠে এই এলাকার লড়াকু লোকজনকেই স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই আমাদের যেসব পূর্বসূরি দূর দেশে জীবনের নোঙর করেছেন, তার মধ্যে গোলাপগঞ্জের লোকজন ছিলেন অগ্রগণ্য। সুরমা ও কুশিয়ারাপারের লোকজন ব্রিটিশদের জাহাজে চাকরির সুবাদে জীবনকে তুচ্ছ করে দূরের অজানা বন্দরে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করেছেন। গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে গেলে আমরা ‘সারেং বাড়ির’ খবর পাই। এসব সারেং আর জাহাজশ্রমিকরাই তাঁদের বেপরোয়া অভিযানে পূর্ব বাংলার লোকজনের প্রবাসযাত্রার ভিত্তি প্রস্তুত করে গেছেন।
সুরমা, কুশিয়ারা থেকে টেমস নদীর তীরে গিয়ে দাপটের ভিত্তি করে গেছেন গোলাপগঞ্জের যে সন্তান, তাঁকে হয়তো আমরা মনে রাখিনি। তবে তাঁর কর্মের সন্ধান আমরা করি। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে মার্কিন মুলুুকেও গোলাপগঞ্জ থেকে আসা লোকজনের সন্ধান পাওয়া যায়। হারলেম, ব্রকলিন, ব্রংকসে তাঁদের পদচিহ্ন আজ আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবজনক অধ্যায়।
প্রবাসপ্রিয়তা বা প্রবাসের গন্তব্য আমাদের এগিয়ে চলাকে স্থানীয়ভাবে ব্যাহত করেছে। অনেক সম্ভাবনাকে অকালে বিনষ্ট করেছে। অর্থবিত্ত আর জীবনসংগ্রামে চাপা অবদমিত হয়েছে অনেক সৃষ্টিশীলতা। থমকে গেছে অনেক উদ্যোগ আর উদ্যম।
আমি নিজেও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি দেশ ছেড়ে প্রবাসের একজন হয়ে উঠি। যতই চেষ্টা করি না কেন, শেকড়ের সাথে আমাদের বন্ধন দৃঢ় রাখা দুরূহ হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অস্থির প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমরা অনেক কিছু করতে চেয়েছি। অনেক কিছুর পরিকল্পনা করেছি।
সফলতা-ব্যর্থতার সালতামামি করার সময় হয়তো আসেনি এখনো। এর মধ্যেই লক্ষ করি, আমাদের একজন আনোয়ার শাহজাহান, যিনি আর সবার থেকে ব্যতিক্রম। দূর দেশের দুই প্রান্তে থাকলেও একজন সৃষ্টিশীল অনুজ হিসেবে তাঁর কাজকর্মের খবর পাই। পেয়ে উদ্বেলিত হই। তাঁর সাফল্য নিয়ে কথা বলতে বলতে নিজের ব্যর্থতার একটা হিসাব করে নেয়ার অবকাশ আসে।
আনোয়ার শাহজাহানকে একজন স্থানীয় সংগঠক হিসেবে প্রথম দেখি নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকেই। একজন ছাত্রসংগঠক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে তাঁর পথচলার শুরুর দিকেই তিনি সবার নজরে আসেন। সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার একদম শুরুর দিকে সম্ভবত আমাদের সাথে তাঁর সংযুক্তি ঘটে। তখন আমাদের বেশ দাপটের সময়। আশপাশে পাওয়া অনুজদের নিয়েই পথচলা। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে নানা কাজে দৌড়ঝাঁপ দিই। দেখা হয় আনোয়ার শাহজাহানের মতো স্বপ্নবাজ তরুণের সাথে।
এমন স্বপ্নবাজ বহু তরুণ শখের বশে সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছেন; আবার খসেও পড়েছেন। কারও কারও বিভ্রান্তি দেখে মানতে কষ্ট হয়। এসব মানুষকে একসময় অনুরাগী, অনুসারী বা সতীর্থ মনে করেছি। আনোয়ার শাহজাহানের বেলায়ও ঠিক তেমনই ঘটতে পারত। যুক্তরাজ্যে প্রবাসী হওয়ার পর অর্থবিত্তের হাতছানির মধ্যে অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের হারিয়ে যাওয়ার গল্প আমরা জানি। অনেকের বিভ্রম-বিভ্রান্তির কথাও আমাদের জানা।
প্রান্তিক জনপদ থেকে উঠে আসা একজন আনোয়ার শাহজাহানের এমন পরিণতি হলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু তাঁর স্বপ্নযাত্রা থেমে যায়নি। নিজেকে গুছিয়েছেন। সম্পৃক্ত থেকেছেন দেশের সাথে, নিজের অঞ্চলের সাথে। এমন কাজ করে অনুকরণীয় হয়ে ওঠা এক অনুজের জন্য লিখতে গিয়েও আনন্দ পাচ্ছি।
আটলান্টিক পাড়ি দেয়া যোজন যোজন মাইলের দূরত্ব পেরিয়েও আনোয়ার শাহজাহানের কাজকর্মের খবর আসতে থাকে। কৈশোরে বা যৌবনে জাতীয় পত্রিকার একজন থানা পর্যায়ের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করা আনোয়ার শাহজাহান আমার কাছে এক অনুজ সংবাদকর্মী হিসেবেই পরিচিত থাকেন।
একপর্যায়ে তাঁর অনেক কর্মের খবর আসতে থাকে। নিজের এলাকায় প্রেসক্লাব গঠন করেছেন। অবহেলিত পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জেলা পর্যায়েও বসার স্থান হয় না। এমন বাস্তবতায় আনোয়ার শাহজাহান নিজের এলাকায় প্রেসক্লাব করার জন্য জমি দান করেছেন। শুনে নিজেই লজ্জা পাই। একই এলাকা থেকে উঠে আসা আমি নিজেও তো এলাকার সাংবাদিক ভাইদের কল্যাণে কিছু করিনি।
আনোয়ার শাহজাহান এমন কাজ করায় আপ্লুত হই। মনে মনে ভাবি, একদিন দেশে গিয়ে আনোয়ার শাহজাহানের দান করা জমিতে গড়ে ওঠা প্রেসক্লাবে বসে আজকের দিনের প্রান্তিক সাংবাদিকদের চার দশক আগের কোনো গল্প শোনাব।
একটি অঞ্চলের লোকজনের কাছে নিজের এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের। আনোয়ার শাহজাহান গোলাপগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থের লেখক। নিজের অঞ্চলের জন্য তাঁর এ কর্মের কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো এ কাজ যথেষ্ট বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার মতো অমূল্য বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কোনো সমন্বিত ইতিহাস আজও রচিত হয়নি। আনোয়ার শাহজাহান বিশাল কর্মপ্রয়াসে উল্লেখযোগ্য একটি কাজ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরোনামে দুই খণ্ডে গ্রন্থ রচনা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীরদের সম্পর্কে একটা গ্রন্থিত রূপ আমরা পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ সময়ের মানুষগুলো একে একে এরই মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছেন। বিস্মৃত হচ্ছেন তাঁরা। এমন গ্রন্থিত রূপ আমাদের অগ্রজদের বীরত্বগাথার স্মারক হয়ে থাকবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাপগঞ্জ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের চারণভূমি। এ অঞ্চলের বীরদের নিয়েই শুধু লিখেননি আনোয়ার শাহজাহান, তাঁর উদ্যোগে আমাদের সবচেয়ে অগ্রসর বীরদের কথা জানার সুযোগ হয়েছে। খন্ডিত হলেও উঠে এসেছে সুসজ্জিত হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াকু যোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের একজন সাংবাদিক হিসেবে আনোয়ার শাহজাহান এ কাজের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তিক জেলা হিসেবে সিলেটের ভ‚মিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীসহ অন্য সেনা নায়কদের বীরত্বকাহিনি আমরা জানি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে এই গোলাপগঞ্জ থেকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন তখনকার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানী। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের স্মারক ছড়িয়ে আছে সমস্ত অঞ্চলে।
আনোয়ার শাহজাহান তাঁর এক অনন্য প্রয়াস হিসেবে সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও সৌধ নামে গ্রন্থ রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশ নিয়ে ভাবিত একজন সৃষ্টিশীল মানুষের কর্ম হিসেবে তাঁর এ প্রয়াস আমাদের জন্য এক মহামূল্যবান দলিল।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বীরত্বের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব দেয়া হয়। খেতাবপ্রাপ্ত এসব মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাথার খবর আমাদের নখদর্পণে নেই। আনোয়ার শাহজাহান সিলেট অঞ্চলের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি পৃথক গ্রন্থ রচনা করে একজন স্বদেশপ্রেমী মানুষ হিসেবে তাঁর সাংবাদিকতার দায় মেটাতে এগিয়ে এসেছেন। এসব কাজের পাশাপাশি নিজের অঞ্চলের বিশিষ্ট লোকজনকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন আনোয়ার শাহজাহান।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর বিচরণ দেখা যায়। নিজের এলাকায় তিনি শিক্ষা আর সংস্কৃতির বিকাশে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। নিজের উপার্জন থেকে দান করেছেন নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নিজের অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য প্রবাসে গড়ে তুলেছেন সংগঠন। তাঁর এসব কর্মপ্রয়াস অব্যাহত আছে দেখে আনন্দিত হওয়ার কারণ খুঁজে পাই।
আনোয়ার শাহজাহান আমার অনুজ। আমরা একই মাঠ থেকে উঠে এসে আজ দেশান্তরি হয়েছি। ফিরে দেখার সময় বুকে এখন হাহাকার ওঠে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীপারের পলল ভূমি বহু উর্বর সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তাঁদের নিয়ে আমাদের অহংকার করার অনেক কিছুই আছে। এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধারণ করে আনোয়ার শাহজাহানের মতো সৃষ্টিশীল মানুষদের সক্রিয় থাকতে দেখে নিজেই অনুপ্রাণিত হই।
সময় আমাদের অনেক কিছুকেই কঠিন করে দেয়। পরিবেশকে বৈরী করে দেয়। সময়ের সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে একজন আনোয়ার শাহজাহান সব সময় সক্রিয় আছেন। তাঁর সক্রিয় এই পথচলার একজন নিবিষ্ট অনুরাগী হয়ে শুভকামনা জানাই। আনোয়ার শাহজাহানের কাজ ও প্রয়াসে অন্যরা অনুপ্রাণিত হবেন।
কর্ম ও প্রয়াসের মধ্য দিয়ে অনুজসম আনোয়ার শাহজাহান নিজেকে সক্রিয় রেখে আমাদের জন্য আরও তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করে যাবেন, এ প্রত্যাশা নিরন্তর।