যুক্তরাজ্যে ল্যাঙ্কাশায়ারের বার্নলি-তে হাছনরাজা উৎসব, একটি পর্যালোচনা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ১০:৫৫:৪০ অপরাহ্ন
হাসনাত মুহঃ আনোয়ার
যুক্তরাজ্যে ল্যাঙ্কাশায়ারের বার্ণলী শহরে গত ২৫ অক্টোবর ২০২২ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হলো হাছনরাজা উৎসব।
একই সপ্তাহে আশেপাশের শহর গুলোতে উৎসব থাকায় উপস্থিতির ব্যাপারে কিছুটা সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু না, আমাদের দুর্ভাবনা ভুল প্রমাণিত। প্রচুর দর্শকের উপস্থিতিতে একটি সফল উৎসব সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।
অবশ্য প্রতি বছর যারা আমাদের ডাকে সাড়া দেন, এমন বেশ কিছু দর্শক শুভাকাঙ্খীকে আমরা ‘মিস’ করেছি। তবুও দর্শক উপস্থিতি এবং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের নিরীখে একটি সফল অনুষ্ঠান হয়েছে বলা যায়।
সেজন্য বৃষ্টি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট শিল্পী, কলাকুশলীসহ সবাইকে অফুরান ধন্যবাদ এবং সীমাহীন কৃতজ্ঞতা জানাই। এ সুযোগে বৃষ্টি’র উদ্যোগে আয়োজিত- হাছনরাজা উৎসবের একটু পর্যালোচনা তুলে ধরতে চাই। একটু হিসেব নিকাশ হলে মন্দ কি ?
করোনা কালের দু বছর (২০২০ ও ২০২১) বাদ দিয়ে এ পর্যন্ত বৃষ্টি আর্টস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বিগত পাঁচ বছরে তিনটি সফল হাছনরাজা উৎসব উদযাপিত হয়েছে। উত্তর ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার এলাকার নয়নাভিরাম পাহাড়টিলা ঘেরা ‘বার্ণলী শহরে’ অনুষ্টিত হয়েছে সবগুলো উৎসব। উত্তর ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি জনসাধারণ বিশেষ করে বার্ণলীবাসী বাংলাদেশী গনের সক্রিয় সহযোগিতা ও উৎসাহ আমাদের যুগিয়েছে অফুরান অনুপ্রেরণা।
শুধু বাংলাদেশিই নন, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির সহযোগিতা ছাড়া এ রকম সফল উৎসব সম্ভব হতো না। এ উৎসবের বিশেষ দিক হলো:
১.
হাছন রাজার গানের উৎসাহী অনুরাগিদের মনোবল বাড়াতে ভূমিকা রাখা। অনলাইন জগতের প্রসারের ফলে এবং এরই সুবাদে- শুধু উত্তর ইংল্যান্ডেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও হাছনরাজার গানের অনুরাগিদের মনোবল চাঙ্গা করতে এ উৎসব সুদুরপ্রসারী ভূমিকা রেখে চলেছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
হাছন রাজার গান প্রচারের ব্যাপারে যারা বিলেতের বাইরে থেকেও আমাদের উৎসাহিত করেছেন কিংবা স্বউদ্যোগে হাছনরাজার গান গেয়েছেন, হাছন রাজা উৎসবের প্রচারে সহযোগিতা করে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের কয়েকজনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। হাছন রাজার প্রপৌত্র অগ্রজ প্রতীম সামারিন দেওয়ানের কথা এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া শিল্পী পার্থ প্রদীপ মল্লিক, হায়দার রুবেল, মোহাম্মদ ফয়সল, টিটো দেব, হাসনাত কবির, ওবায়দুল হক মুন্সী, আরও অনেকে হাছনরাজা উৎসবের প্রচারে বাংলাদেশ থেকেও অনলাইন সরগরম করেছেন। ঢাকা থেকে জনপ্রিয় শিল্পী বাউল গরীব মুক্তার হাছনরাজার একটি অপ্রচলিত গান নিজে সুর করে একটি টিভি চ্যানেলে পরিবেশন করেছেন। হাছন রাজার একটি হিন্দি গান ‘পিয়ারারে বালা’ আমাদের গতবারের উৎসবে গাওয়া হয়। সামারিন দেওয়ানের সহযোগিতায় গানটির সুর সংগ্রহ করা হয়। বিলাতের প্রখ্যাত শিল্পী সুজানা আনসার গানটি সাফল্যের সাথে গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। সুদুর পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ থেকে প্রবীন শিল্পী রমেন দাশ বৈরাগ্য বিভিন্ন আসর অনুষ্ঠানে হাছন রাজার গান গেয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের প্রচারে সহযোগিতার লক্ষে চট্টগ্রামের শিল্পী আলাউদ্দীন কাওয়াল হাছন রাজার গান গেয়ে হাছনরাজা উৎসবের প্রচারে আমাদের সহযোগিতা করে থাকেন।
সার্বিক বিচারে হাছন রাজার গান প্রচারে এখানে উল্লিখিত সকলের ভূমিকা সুদুর প্রসারী ফল বয়ে আনবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সকলের প্রতি আমাদের সীমাহীন শুভকামনা।
২.
একটি ইংলিশ জাজ ব্যান্ড হাছন রাজার গানের ফিউশন হিসেবে হাছন রাজার কিছু গান এবং বেশকিছু বাংলা লোকগান হাছন উৎসবে গেয়ে থাকেন। এ গানগুলো নিয়ে ‘বৃষ্টির গান’ শিরোনামে একটি এলবাম বাজারে আসবে খুব শীঘ্রই, এর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। অনলাইনে অর্ডার করে যে কেউ গানগুলো শুনতে পারবেন। বিস্তারিত শীঘ্রই জানানো হবে। এ কাজের জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয় Chris Bridges কে। (a special thanks to Chris Briggs and team for their unique initiative) আগামীতে এ টিম বিলেতের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠেয় উৎসবে জাজ ও বাংলা লোক সঙ্গীতের ফিউশন নিয়ে ট্যুরে বের হবার পরিকল্পনা চলমান। এর মাধ্যমে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ভূবনে হাছন রাজার গানসহ বাংলা লোকসঙ্গীতের সগৌরব উপস্থিতি আমাদের কাছে খুবই আনন্দ ও তৃপ্তিদায়ক।
৩.
২য় হাছন রাজা (২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯) উৎসব উপলক্ষে লোকসঙ্গীত ও হাছন রাজার গানে বিশেষ অবদানের জন্য মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে বৃষ্টি এওয়ার্ড প্রদান করা হয়। হাছন রাজা উৎসব উপলক্ষে এই গুনীজনকে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সুদুর বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। এর ফলে বিলেত প্রবাসী লোকগানপ্রেমীদের মধ্যে অভূতপুর্ব সাড়া পড়ে।
বিলেতবাসী তিনজন বরেণ্য গীতিকবিকে হাছনরাজা উৎসবে ‘বৃষ্টি এওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়। এরা হলেন:
নবীন সিদ্দেক, সৈয়দ দুলাল এবং কুতুব আফতাব (মরহুম)।
এ উদ্যোগ সর্বমহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। আমাদের এ এওয়ার্ড প্রদানের প্রয়াস চলমান থাকবে।
৪.
আমাদের লোকসঙ্গীতের চিরসবুজ বাছাই করা গানগুলোর কয়েকটি নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘বৃষ্টির গান’। প্রতিটি গানের মিউজিক স্কোর (ইংরেজি স্বরলিপি), পদকর্তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বাংলা ও ইংরেজিতে বইটিতে স্থান পায়। এর ফলে- অবাঙ্গালি যে কেউ এবং আমাদের বিদেশে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম বাংলা না জানলেও এ বই অনুসরণ করে অনায়াসে এ বইয়ের প্রদত্ত লোকসঙ্গীত বাজাতে পারবেন।
৫.
হাছন রাজা উৎসবে বিলাতের জনপ্রিয় শিল্পীরা অংশ নিয়ে হাছন রাজার গান পরিবেশন করে শ্রোতাদের বিমোহিত করেন। বিগত উৎসবগুলোতে যেসব শিল্পী আমাদের সাথে ছিলেন, এরা হলেন: আমীর মোহাম্মদ, শিল্পী সুজানা আনসার, শিল্পী অমিত দে, শিল্পী শতাব্দী রায়, বাউল এম হোসেন, শিল্পী মম রুপা দাশ, শিল্পী রোজী সরকার এবং অন্যান্য।
৬.
বিলেতে বাংলা লোকসঙ্গীতের চর্চার শুরু সেই ষাটের দশকে। সেই থেকে এ ধারা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিলাত প্রবাসী গীতিকবির লেখা গান বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে সমাদৃত হয়েছে। বাংলাদেশের মূলধারার প্রচার মাধ্যমে এদের অনেকের গান সমাদৃত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এই গীতিকবিদের অনেকেই কয়েক হাজার গানের রচয়িতা এবং অনেকেরই মুদ্রিত গানের বই রয়েছে। প্রবীনদের মধ্যে অনেকেই পরপারে চলে গিয়েছেন। কেউ কেউ বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছেন। সেই বিস্মৃত অতল থেকে তুলে আনার কাজটিও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিনের মধ্যে এমনি কয়েকজনের ‘জীবন কথা ও রচনাবলী’ সংগ্রহ করে ‘বৃষ্টি এওয়ার্ড’ প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে আমরা সকলের সহযোগিতা চাই।
শেষ কথা
প্রবাস জীবন বলি, আর অভিবাসী জীবনই বলি এখানে কর্মব্যস্ততা রয়েছে সবারই। জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত সবাই। এর ফাঁক গলে যে সময়টুকু বের করা যায়, তা কাজে লাগিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মত সুকুমার বৃত্তির কাজটুকু করতে হয় আমাদের। তাই আমাদের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে বেশ। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের কাজের মূল্যায়ন করাই হবে আমাদের প্রতি সুবিচার।