বৃটেনে রেকর্ড গড়লেন লর্ড মেয়র হাবিব: তাঁর অবিস্মরণীয় বিজয়ের কিছু কথা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ মে ২০২১, ৯:০৫:০৪ অপরাহ্ন
বৃটেনের নিউক্যাসলের নবনির্বাচিত প্রথম মুসলিম লর্ড মেয়র সিলেটের বালাগঞ্জের হাবিব রহমানের সাথে গতকাল ২৮মে ফোনে আলাপ হয় অনুপমনিউজ২৪-র সম্পাদক মুহিব উদ্দিন চৌধুরী ও নির্বাহী সম্পাদক সারওয়ার চৌধুরীর। আলাপে উঠে এসেছে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্ট।
➡️ ‘চুয়াল্লিশ বছর আগে এই মে মাসেই, ১৯ মে তারিখে আমার আব্বা বর্ণবাদের শিকার হয়ে, বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গের চাকুর ঘা শরীরে নিয়ে ইন্তেকাল করেছিলেন। এই মে মাসেই, ২৬ মে আমি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে করতে অবশেষে বৃটেনের ৮০০ বছরের ইতিহাসে নিউক্যাসেলে প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে লর্ড মেয়র পদে অধিষ্ঠিত হলাম।
আমার বাবাকে ওরা যখন পৃথিবী থেকে বিদায় করেছিল, তখন আমার বয়স ৩ বছর মাত্র। আমি কিছুই জানতাম না। আমার মা আমাকে সব বলেছেন। আমি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার মা বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। মা ৩৪ বছর বয়সে বিধবা হন। অনুষ্ঠানে বলেছি আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ট মা। তাঁর ত্যাগের পরাকাষ্ঠা, সকল ধর্ম ও মতের মানুষের প্রতি দরদ রাখার চিন্তা, তাঁর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি। আমার মা আমার বাবার হত্যাকারীকে ঘৃণা করেন না। তিনি বলেন আল্লাহর হুকুম যা হওয়ার তা হয়েছে।’
কথাগুলি বৃটেনের নিউক্যাসলের লর্ড মেয়র সিলেটের বালাগঞ্জের হাবিব রহমানের। তিনি ডেভিড কুকের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ২৬ মে ২০২১। তিনি ভাবগম্ভীর হয়ে ২৮ মে ফোনে কথা বলছিলেন অনুপমনিউজ২৪-র সম্পাদক মুহিব উদ্দিন চৌধুরী ও নির্বাহী সম্পাদক সারওয়ার চৌধুরীর সাথে।
সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার উমরপুর হাবিব রহমানের গ্রামের বাড়ি। তিনি চমৎকারভাবে সিলেটি (বালাগঞ্জ ডায়ালেক্টে) বলছিলেন। ইংরেজি বলেন ইউকে এ্যকসেন্টে। নিজের শিকড়ের প্রতি তাঁর টান অনড় রয়েছে বৃটেনের নাম্বার ওয়ান সিটিজেন হওয়া সত্বেও। মুসলিম হিসাবেও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন।
আমি বর্ণবাদকে পরাজিত করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। আমি মানুষকে বুঝাই, ব্যক্তির কৃতিত্ব আসে তার কর্মগুণে। ব্যক্তি কোনো গোষ্ঠীর, ধর্মের বর্ণের হতে পারে। ব্যক্তির দুষ্কর্ম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটির কেবল। এর জন্যে তার ধর্ম বর্ণ গোত্রকে সমষ্টিগতভাবে দায়ী করা ঠিক না।
তিনি জানান, ‘মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৮৫ সালে ৬ ভাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ছেড়ে বৃটেনের টাউনসাইডে এসেছিলেন। তখন তিনি ইংরেজি বলতেই পারতেন না। তখন তিনিও বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন, শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। বললেন,
‘১৯৮৫ সালে যখন বর্ণবাদীরা আমাকে আক্রমণ করতো, আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না কেন তারা আমাকে ঘৃণার নজরে দেখে। পরে যখন বিষয়টা বুঝলাম তখন থেকেই আমি বর্ণবাদকে পরাজিত করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। আমি মানুষকে বুঝাই, ব্যক্তির কৃতিত্ব আসে তার কর্মগুণে। ব্যক্তি কোনো গোষ্ঠীর, ধর্মের বর্ণের হতে পারে। ব্যক্তির দুষ্কর্ম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটির কেবল। এর জন্যে তার ধর্ম বর্ণ গোত্রকে সমষ্টিগতভাবে দায়ী করা ঠিক না। আমি বুঝাই, শাদা মানুষ কালো মানুষ এ কেবল বাইরের রূপ, ডিপ ডাউনে অভিন্ন রূপ। শাদা ও কালো মানুষ উভয়ের রক্ত লাল।’
২৬ মে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হাবিবুর রহমানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। বৃটেনের অনলাইন ক্রনিক্যাল লাইভও এ খবর প্রচার করেছে।
হাবিব রহমানের এ পদে আসা এক বছর বিলম্বিত হয়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে। বার্ষিক জেনারেল মিটিংয়ে তিনি নিউক্যাসল সিটি কাউন্সিলে এ পদে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হন। তিনি বৃটেনের বর্তমান বিরোধী দল লেবার পার্টির সমর্থক। দুই বছর নিউক্যাসেল শেরিফ এবং ডেপুটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন হাবিব। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরই তিনি গভীর আবেগঘন বক্তব্য রেখেছেন।
ফোনে আলাপকালে বললেন, ‘আমার বাবা আজিজুর রহমান একা এসেছিলেন বৃটেন। তিনি খুন হওয়ার সময় আমরা বাংলাদেশে ছিলাম। তিনি কাজ করতেন ওয়ালসেন্ড রেস্তোরাঁয়। সেখানে একজন শ্বেতাঙ্গ কাস্টমারকে দেয়া তরকারির পরিমাণ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ঐ কাস্টমার তাকে ছুরিকাঘাত করে। তৎক্ষণাৎ তিনি মারা যান। মানে নিউক্যাসল আসার ১০ দিনের মাথায় আমার বাবা ইহকাল ত্যাগ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেয়ার সময় হাবিব রহমান তার সহকর্মীদের বলেছেন, নিউক্যাসেলে তার শৈশবের দিনগুলো বাধাগ্রস্ত হয়েছিল নিষ্ঠুর বর্ণবাদে। একজন এশিয়ান মুসলিম হিসেবে এই শহরে তাঁর যে অভিজ্ঞতা তা থেকে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেন, বৈষম্যকে একদিন পরাজিত করবেন।
তিনি আরও জানালেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কাজ করার সময় তার বেশিরভাগ সাথী ছিলেন শাদা বর্ণের।
কাউন্সিলর লর্ড মেয়র হাবিব রহমানের বয়স ৪৭ বছর চলছে। নিজের এ কৃতিত্ব নিয়ে তিনি বলেছেন, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্তগুলির একটি। তিনি তার দায়িত্বকে ব্যবহার করে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সহনশীলতা এবং সমতাকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিন সন্তানের পিতা হাবিব রহমান বলেন, এভাবেই ইতিহাস নির্মিত হয়। এই ইতিহাস আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। তা সত্ত্বেও এই দায়িত্ব নিয়ে এই শহরকে সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি এবং লিঙ্গের মানুষদের জন্য অবাধ ও উন্মুক্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে। আমি এটা অনুমোদন করবো। আমি ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ এবং যেকোনো রকম বর্ণবাদকে চ্যালেঞ্জ জানাই এবং নিন্দা জানাই। ১২১৬ সালে নিকোলাসের ছেলে ডানিয়েলের পর থেকে মেয়র পেয়েছেন নিউক্যাসেলবাসী। কিন্তু ১৯০৬ সালের আগে সেখানে লর্ড মেয়রের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ঐ সময় ষষ্ঠ কিং এডওয়ার্ড একটি ডিক্রি জারি করে এই পদ সৃষ্টি করেছিলেন।
বর্ণবাদ বিরোধী গ্রুপ শো রেসিজম দ্য রেড কার্ড (এসআরটিআরসি) এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হাবিবুর রহমান। বুধবার তার দায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের সাবেক তারকা ও এসআরটিআরসির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জন বেরেসফোর্ড। তিনি বলেছেন, ১৯৯৮ সাল থেকে এসআরটিআরসির একজন ব্যতিক্রমী সমর্থক হাবিবুর রহমান। বৃটেনে বর্ণবাদ বিরোধী শিক্ষা বিষয়ক দাতব্য সংস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন। নিউ ক্যাসেলের লর্ড মেয়র হিসেবে তিনি নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকে পাশে রেখে আমরা অর্থসংগ্রহের নতুন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেবো। তা নিয়ে আলোচনা হবে।
এসআরটিআরসির প্রেসিডেন্ট শাকা হিসলোপ বলেছেন, হাবিবুর রহমানের রাজনীতিতে উত্থান দেখে বাস্তবেই গর্ব বোধ হচ্ছে। যারা খুব অভাবে তাদেরকে সমর্থনে হাবিব সমসময়ই এগিয়ে গেছেন। শো রেসিজম দ্য রেড কার্ড উদ্যোগে কাজের মাধ্যমে আমি হাবিবকে চিনতে পেরেছি। আর সেই সুবাদে এই ইতিহাস রচনা হতে দেখছি। এই শহরের প্রতি আমাদের সবার ভালবাসা আছে। সম্মান আছে।
মা ৩৪ বছর বয়সে বিধবা হন। অনুষ্ঠানে বলেছি আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ট মা। তাঁর ত্যাগের পরাকাষ্ঠা, সকল ধর্ম ও মতের মানুষের প্রতি দরদ রাখার চিন্তা, তাঁর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি।
লেবার দলের কাউন্সিলর ইরিম আলি নিউক্যাসেল নিয়ে আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনিই আনুষ্ঠানিকভাবে লর্ড মেয়র হিসেবে হাবিব রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। শহরের লেবার নেতা এবং কাউন্সিলর নিক ফোরবিস বলেছেন, হাবিবুর রহমানকে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে নিউক্যাসেল এবং আমাদের মূল্যবোধের বিষয়ে শক্তিশালী বার্তা দেয়া হয়েছে। প্রচলিত মেয়রাল চেইনে এখন আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের একত্রিত করছি। আমরা তাদেরকে বন্ধুত্বের বন্ধনে একত্রিত করছি।
তাঁর কাছে অনুপমনিউজ২৪ এর পক্ষ থেকে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, এ বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর জন্মভূমির মানুষকে কী বার্তা দেবেন? বললেন,
‘সমাজের সমস্যা চিহ্নিত করে, দোষী ব্যক্তিটিকে কেবল দায়ী করে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। গোষ্ঠী-দল বা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সবাইকে খারাপ ভাবা ঠিক না। স্বজনপ্রীতি, দলীয় পক্ষপাত বিবেচনায় নিয়ে সমস্যার সমাধান যথাযথ হয় না, সুবিচার সম্ভব হয় না।’
নিউক্যাসেলের এ নবনির্বাচিত লর্ড মেয়র হাবিব রহমান তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।