ইসলামী শিল্পকলায় সুফিবাদের প্রভাব
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২:১৯:৩২ অপরাহ্ন
আতাউর রহমান খসরু
ইসলাম সৌন্দর্যের ধর্ম। ইসলাম মানুষকে জীবনের প্রতিটি স্তরে সৌন্দর্য ধারণ ও লালনের শিক্ষা দেয়। ইসলাম বলে, মুমিন তার বোধ, বিশ্বাস, আচরণ, কথা, কাজ ও জীবনযাপনে কদর্য পরিহার করবে এবং সৌন্দর্য অর্জন করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ সুন্দরতম, তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫১)
হাদিসবিশারদরা বলেন, এটি একটি ব্যাপকার্থক হাদিস, যা মুমিনকে সমগ্র জীবনে সৌন্দর্য ধারণে উৎসাহিত করে, যতক্ষণ না তা মানুষের অহংকার ও অহমিকার কারণ হয়।
সুফিবাদের পরিচয়
সুফিবাদের পরিচয় নির্ধারণে মনীষীরা ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন। যার মূলকথা হলো, আত্মিক পরিশুদ্ধি, দুনিয়াবিমুখতা ও ইবাদতে মগ্ন হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভের সাধনা। আল্লামা কুশাইরি (রহ.) বলেন, ‘তাসাউফ হলো মানবীয় গুণাবলির ওপর দ্বিনি গুণাবলিকে প্রাধান্য দেওয়ার অনুশীলন।’
(আর রিসালা, পৃষ্ঠা-১২৬)
আল্লামা আবুল আলা আফিফি (রহ.) বলেন, তাসাউফ হলো আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার এমন অবস্থা, যা বান্দার ধ্যান ও জ্ঞান থেকে গাইরুল্লাহর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়। (তাসাউফ : সাউরাতুন রুহিয়্যাতুন ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা-৩৮)
সুফিবাদের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক
সুফিবাদের মূলকথা হলো সব কদর্য থেকে আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে চারিত্রিক সৌন্দর্য অর্জন করা, যা প্রস্ফুটিত হয় তার কথা, কাজে ও সব কর্মকাণ্ডে। ড. মাহদি সাইফুদ্দিন বলেন, সুফিবাদের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের সুগভীর সম্পর্ক আছে। কেননা মননের সৌন্দর্য শিল্পে বিকশিত হয়।
এ জন্য আমরা দেখি সুফিবাদে প্রভাবিত অঞ্চলগুলোর শিল্পকর্মের ভেতর একটি গভীর সংযোগ ও সাদৃশ্য আছে। যেমন—নকশা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার, রঙের প্রতীকায়ন ইত্যাদি। আপনি বিশ্লেষণ করলে তুর্কি, মোগল ও পার্সিয়ান শিল্পকলার ভেতর যে অভিন্নতা খুঁজে পাবেন তা মূলত সুফিবাদেরই প্রভাব। (আসরু ফালসাফাতিল সুফিয়্যাতি ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা-৪৯৬)
ইসলামী শিল্পকলায় সুফিবাদের প্রভাব
মসজিদ, মাদরাসা, প্রাসাদসহ মুসলিম স্থাপত্যগুলোতে শিল্প ও কারুকাজ বিশ্লেষণ করলে মৌলিকভাবে পাঁচ ধরনের নকশা ও কারুকাজ পাওয়া যায়। তাহলো—১. লতাপাতা, ২. ফুল ও ফল, ৩. পানপাত্র, ৪. ঝরনা, ৫. ক্যালিগ্রাফি।
সুফি সাধকরা এর প্রতিটিকে বিশেষ অর্থে প্রতীকায়ন করে থাকেন। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো—
১. লতাপাতা ও উদ্ভিদ : মানুষের অন্তরে আল্লাহর স্মরণ ও ভালোবাসার সক্রিয় উপস্থিতিকে বুঝায়। কেননা আল্লাহর স্মরণ ও প্রেমশূন্য হৃদয় মৃত ভূমির মতো। বিপরীতে আল্লাহর স্মরণ ও ভালোবাসায় মগ্ন হৃদয় সবুজ ও সজীব প্রান্তরের মতো। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের জিকির করে এবং যে তার প্রতিপালকের জিকির করেন না, তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪০৭)
২. ফুল ও ফল : ফুল ও ফলকে সুফি আলেমরা নেক কাজের প্রতিফলের প্রতীক বলেন। আর তাহলো জান্নাত। কেননা মহান আল্লাহ কোরআনে একাধিক স্থানে জান্নাতের নিয়ামতগুলো বর্ণনায় ফলের উল্লেখ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এটাই জান্নাত, তোমাদেরকে যার অধিকারী করা হয়েছে, তোমাদের কাজের ফলস্বরূপ। সেখানে তোমাদের জন্য আছে প্রচুর ফলমূল, যা থেকে তোমরা আহার করবে।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৭২-৭৩)
আবার কোনো সুফি ফলকে সাধারণ নিয়ামতের প্রতীক এবং ফুলকে জান্নাতি রমণীর প্রতীক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেননা এটা স্বীকৃত যে উপমা হিসেবে নারীরা ফুলের মতোই।
৩. পানপাত্র : পানপাত্র দ্বারা সুফি আলেমরা আল্লাহ প্রেমের আধিক্য বা তাতে নিমগ্নতা বোঝায়, যা তাঁকে জগৎ-জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে। যেমন—আল্লামা রুমি তাঁর এক কবিতায় বলেছেন,
তিনি বললেন, আমা হতে তোমার কি প্রত্যাশা?
আমি বললাম, আপনার অপরিসীম অনুগ্রহ।
তিনি বললেন, যাত্রাপথটিতে কে ছিল তোমার সঙ্গী?
আমি বললাম, আপনার ধ্যান, হে আমার প্রভু!
তিনি বললেন, কে তোমায় এখানে প্রলোভিত করে এনেছে?
আমি বললাম, আপনার শরাবের ঘ্রাণ।
তিনি বললেন, কী বয়ে নিয়ে আসে তোমার মনে সবচেয়ে পরিপূর্ণতা?
আমি বললাম, প্রভুর সান্নিধ্যে। (মাসনবিয়ে রুমি)
৪. ঝরনা : সুফি আলেমদের কাছে ঝরনা বা পানির প্রবাহ আল্লাহভীতি ও বিনয়ের প্রতীক। কেননা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এর পরও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল, তা পাষাণ কিংবা তার চেয়ে কঠিন। পাথরও কতক এমন যে তা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়, কতক এরূপ যে বিদীর্ণ হওয়ার পর তা থকে পানি নির্গত হয়, আবার কতক এমন যা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ে এবং তোমরা যা করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অনবহিত নন।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৭৪)
আবার এটা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ লাভেরও প্রতীক। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহ বান্দার প্রতি অবিরাম বর্ষিত হতে থাকে।
৫. ক্যালিগ্রাফি : ইসলামী ক্যালিগ্রাফি, যাতে মূলত কোরআন, হাদিস ও মনীষীদের বাণী উত্কীর্ণ হয়, তা জিকিরের উপকার দেয়। এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত হয়, মানুষ উপদেশ গ্রহণের মাধ্যমে সুপথের দিশা লাভ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি স্মরণ করুন! কেননা স্মরণ মুমিনদের উপকৃত করে।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ৫৫)
রঙের প্রতীকায়নে সুফিবাদের প্রভাব
ইসলামী শিল্পকলায় রঙের প্রতীকায়নে সুফিবাদের দৃশ্যমান প্রভাব রয়েছে। যেমন—সুফি সাধকদের কাছে নীল রং আধ্যাত্মিকতা ও জান্নাতের প্রতীক। নীল আধ্যাত্মিক মগ্নতা ও ধ্যানের প্রতি ইঙ্গিত করে। ইসলামী স্থাপত্যে টালি, গম্বুজ ও ছাদের অভ্যন্তর ভাগের কারুকাজে ব্যবহৃত হয়। নীল রংটি মহাবিশ্বের অন্তহীন গভীরতাকেও ধারণ করে। গাঢ় নীল জলের রহস্যময় জগতের প্রতি ইঙ্গিত করে। নীল আকাশ বা আসমানেরর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে আল্লাহর আরশ অবস্থিত। সাধকদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য ও কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানের দূরতম গন্তব্যের অনুস্মারক নীল।
হিজরি একাদশ শতকে এই অঞ্চলে সুফি মতবাদের প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে শিল্প-সাহিত্যে স্রষ্টার প্রেম ও তাঁর বিরহ নানাভাবে প্রস্ফুটিত হয়। স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে কালো রং এবং স্রষ্টার প্রতাপ বোঝাতে লাল রঙের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। উসমানীয় আমলের শিল্পীরা হালকা ও উজ্জ্বল রং বেশি ব্যবহার করত। তারা সুফি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। রঙের প্রতীকী ব্যবহারে তারা অত্যন্ত সচেতন ছিল। যেমন—তারা শক্তি ও বিজয় বোঝাতে লাল রং, পার্থিব ও পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধি বোঝাতে সবুজ, আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা বোঝাতে নীল, পবিত্রতা বোঝাতে সাদা, আলো ও সুপথ বোঝাতে হলদে সোনালি রং ব্যবহার করত। উসমানীয় শিল্পীরা সচেতনভাবে কালো রং এড়িয়ে চলত।
তথ্যঋণ—প্রবন্ধ : দ্য ইম্প্যাক্ট অব সুফিজম ইন ইসলামিক আর্ট এবং সিগনিফিকেন্স অব কালারস ইন ইসলামিক আর্ট হিস্টোরি
(কালের কণ্ঠের সৌজন্যে)