সকল ক্ষমতার মালিক যাতে জনগণ হতে পারেন তেমন দেশ গড়তে চাই: প্রধান উপদেষ্টা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২:২৬:৪৫ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের যে স্বপ্ন নিয়ে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করেছিলেন, আমি তাদের সেই স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা এখন থেকে বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই-যেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণই হবে সকল ক্ষমতার মালিক।’
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা সেনানিবাসে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সশস্ত্র বাহিনী দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তী সময় এবং সংকটকালে সব সময় সশস্ত্র বাহিনী দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনী আবারও দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। এ নতুন দেশে আমাদের দায়িত্ব সকল মানুষকে এক বৃহত্তর পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। কেউ কারো ওপরে না, আবার কেউ কারো নিচেও না: এই ধারণা আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’ বিশ্ব দরবারে মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখব। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক সম্মান, আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক শান্তি ও অর্থনীতি সুসংহতকরণে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি লাভ করেছে। দেশ স্বাধীন করার মহান ব্রত নিয়ে ‘৭১ এর ২৫ মার্চ কাল রাত থেকে বাঙালি সেনারা সেনানিবাস ত্যাগ করে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একই সঙ্গে এই দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা সাধারণ মানুষ সকলেই যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। পরবর্তী সময়ে যা একটি জনযুদ্ধে রূপ নেয়। আমাদের মা-বোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ বিভিন্নভাবে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন।’ সরকার প্রধান বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল বাহিনীকে ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস’ নামে সাংগঠনিক রূপ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। মাত্র দুইটি গান বোট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী জলপথে যুদ্ধ শুরু করে। এছাড়াও পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশি সাবমেরিনার এবং নাবিকদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা অকুতোভয় নৌ কমান্ডো দল ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন নদীবন্দরে খাদ্য ও রসদ বোঝাই শত্রু জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। বিমান বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘কিলো ফ্লাইট’ চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের জ্বালানি ডিপোসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সফল অভিযান পরিচালনা করে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর এই অবদানকে সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করার উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর পালিত হয় সশস্ত্র বাহিনী দিবস।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অকুতোভয় সদস্য এবং বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ সূচনা করে। সেই আক্রমণের ফলে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সকল বীর শহিদদের এবং মহান আল্লাহর দরবারে আমি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আমি সকল শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য এবং সম্মানিত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের এই আয়োজনে আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে যে সকল খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীগণ উপস্থিত আছেন তাদের জন্যেও রইল আমার বিনীত শ্রদ্ধা।’
তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদ্যাপনকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী যে উদ্যোগ প্রতি বছর নিচ্ছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এজন্য সশস্ত্র বাহিনীকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ড. ইউনুস বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে সম্প্রতি আমরা অর্জন করেছি, সেটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ, আহত এবং জীবিত ছাত্র-জনতার কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই। যে সুযোগ তারা আমাদেরকে দিয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের কল্যাণার্থে যা কিছু প্রয়োজন তা করার জন্য আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
‘সশস্ত্র বাহিনী জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক’
প্রধান উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তী সময় এবং সংকটকালে সব সময় সশস্ত্র বাহিনী দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনী আবারও দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’
সশস্ত্র বাহিনীর অবদান স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনুস বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ, দুর্যোগ মোকাবিলা, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং সাধারণ মানুষ এক হয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আক্রমণ চালিয়েছিল। তিনি বলেন, ২১ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের একটি মাইলফলক হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সশস্ত্র বাহিনী ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে, যেখানে সেনা, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণও প্রদান করে। তিনি বলেন, এই বিশেষ দিনে আমি গভীরভাবে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের শহিদ এবং সব সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ করে আহত করা হয়েছিল। প্রধান উপদেষ্টা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সকল শহিদ এবং আহতদের স্মরণ করেন।