মসজিদে নববি যেভাবে তৈরি হল
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৯:০৮ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র রওজা সংযুক্ত থাকায় মসজিদে নববির প্রতি মুসলমানদের শ্রদ্ধা ও আবেগ অত্যন্ত বেশি। এই মসজিদের পাশেই ছিল মুহাম্মাদ (সা.)-এর বসবাসের ঘরটি।
তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মসজিদটির নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, মসজিদে নববিকে ঘিরেই ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল।
৬২২ সালে মক্কা থেকে ৮ দিনের দীর্ঘ যাত্রার পর মদীনার উপকণ্ঠে কুবা নামক স্থানে এসে অবতরণ করলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। কয়েক দিন পরেই শুরু হয় মসজিদ নির্মাণের কাজ। ৬২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সাত মাস সময় লাগে কাজ শেষ হতে।
মদিনায় প্রবেশের পর রাসুল (সা.)-এর উট যে জায়গাটিতে বসে পড়েছিল, সেখানেই তৈরি করা হয় ঐতিহাসিক মসজিদে নববি। মদিনার দুই এতিম বালক সাহল ও সোহাইলের কাছ থেকে ১০ দিনারের বিনিময়ে জায়গাটি কিনে নেওয়া হয়। টাকা পরিশোধ করেন হজরত আবু বকর (রা.)। জমির ছোট এক অংশে রাসুল (সা.)-এর ঘর এবং বাকি অংশ জুড়ে তৈরি করা হয় মসজিদ।
যেভাবে নির্মিত হল মসজিদে নববি
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, মদিনায় পৌঁছার পর বনি আমর ইবনে আওফ গোত্রের এলাকার উঁচুভূমিতে চৌদ্দ রাত অবস্থান করেন রাসুল (সা.)। এ সময় বনি নাজ্জারের লোকজন তাকে ঘিরে ছিল। সবার মনে একটাই আকুতি, নবীজি (সা.) যেন তাদের মেহমান হন। আল্লাহর কুদরতি ফায়সালাকারী উট আবু আইয়ুব আনসারির বাড়িতে এল। সেখানেই নবীজি (সা.) অবস্থান করলেন।
প্রথম মসজিদে নববি হিজরি ১ সালে রসুল স. এর হাতে নির্মিত
আনাস (রা.) বলেছেন, যেখানে নবীজির (সা.) উট থেমেছিল, তার সীমানায় ছিল একটি বাগান। বাগানটিতে ছিল খেজুরগাছ, কিছু কবর আর ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ।
বাগান মালিকদের অনুমতি পেয়ে নবীজি (সা.) নির্দেশ দিলেন, খেজুর গাছগুলো কেটে ফেলো, কবরগুলো খুঁড়ে ফেলো এবং ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দাও। জায়গাটি পরিষ্কার করে শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ।
হিজরতের পর মদিনায় বিদ্যুৎগতিতে ইসলামের প্রসার ঘটতে লাগল। মসজিদে নববিতে জায়গা দ্রুতই সংকীর্ণ হয়ে আসতে লাগল মুসল্লিদের ভিড়ে।
অতঃপর ৭ম হিজরীতে খাইবার যুদ্ধের পর রাসূল (সা.) মসজিদটিকে প্রস্থে ৪০ হাত এবং দৈর্ঘ্যে ৩০ হাত সম্প্রসারণ করলেন। এতে মসজিদটি ২ হাজার ৫০০ বর্গ মিটারের একটি বর্গাকার গৃহে পরিণত হল।
যুগে যুগে বহু সংস্কার ও সম্প্রসারণ হয়েছে এই মসজিদের। আব্দুল্লাহ ইবন উমরের বর্ণনা অনুযায়ী, রাসুল (স.)-এর যুগের মসজিদের ভিত্তি ছিল ইটের, ছাদ ছিলো খেজুরের ডালের এবং খুঁটি ছিলো খেজুর গাছের কাণ্ডের। সেসময় মসজিদের পরিধি ছিল আনুমানিক ২৫০০ মিটার। ৭ম হিজরিতে মসজিদে নববির প্রথম সম্প্রসারণ রাসুল (স.) নিজেই করেন। তখন আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৭৫ স্কয়ার মিটারে। এরপর ৬৩৮ সালে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) মসজিদে নববির সংস্কারে হাত দেন। মসজিদের চারপাশে জমি কিনে এর আয়তন বৃদ্ধি করেন। তবে যেদিকে উম্মাহাতুল মুমিনিনদের ঘর ছিলো সেদিকটা অপরিবর্তিত রাখা হয়।
৭০৭ সালে খলিফা উমাইয়া শাসক ওলিদ ইবনে আব্দুল মালিকের নির্দেশে মক্কার গভর্নর ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ মসজিদে নববির সম্প্রসারণ করেন। সেসময় মসজিদের পরিধি বৃদ্ধি হয় ৬ হাজার ৪৪০ বর্গমিটার। তিনি মসজিদে চারটি মিনারা ও একটি মেহরাব স্থাপন করেন। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ স্তম্ভগুলোকে মরমর পাথর ও সোনার কারুকার্জ দিয়ে সাজান। এসময় স্তম্ভের সংখ্যা ছিল ২৩২টি। তিনি হজরত আয়েশা (রা.)-এর কক্ষটি মসজিদে নববির অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তার উপর নয়নাভিরাম সবুজ গম্বুজ স্থাপন করেন।
আব্বাসী খলিফা আল মাহদি ১৬১ থেকে ১৬৫ হিজরিতে মসজিদের আয়তন ৮হাজার ৮৯০ বর্গমিটারে উন্নিত করেন। ৬০টি জানালা ও ২৪টি দরজা লাগান তিনি।
৬৫৪ হিজরিতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে খলিফা আল মুতাসিম মসজিদে নববি পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু ৬৫৬ হিজরিতে তাতারিরা বাগদাদে হামলা করলে খলিফার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
মামলুক শাসনামলেও মসজিদে নববীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়। প্রধান চারটি ফটক ছাড়া অন্য দরজাগুলোকে পিতল দিয়ে নকশা ও সজ্জিত করা হয়।
উসমানি খলিফা সুলতান সুলেমান গম্বুজ মেরামত করেন এবং তার উপর সোনায় মোড়ানো চাঁদ স্থাপন করেন। ১২৭৭ হিজরিতে ফাটল দেখা দিলে সুলতান আব্দুল মাজিদ মসজিদের সংস্কার করেন। তখন মসজিদের আয়তন বেড়ে ১০ হাজার ৩০৩ বর্গমিটার হয়। এসময় তিনি পাঁচটি নতুন দরজা সংযুক্ত করেন এবং ১১ মিটার পর্যন্ত প্রাচীরের উচ্চতা বৃদ্ধি করেন। তাছাড়া ১৭০টি গম্বুজ ও ৬০০টি তেলপ্রদীপ স্থাপন করেন।
১৯০৯ সালে এই মসজিদের মাধ্যমেই আরব উপদ্বীপের বিদ্যুতায়ন শুরু হয়। সৌদি যুগ শুরু হলে বাদশাহ আব্দুল আজিজ ১৯৫০ সালে মসজিদে নববীর পরিধি ১৬ হাজার ৩২৭ বর্গমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। এসময় মসজিদের স্তম্ভ ছিল ৭০৬টি ও গম্বুজ ছিল ১৭০টি।