গতকাল ৪.৬, দুই সপ্তাহ আগে ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হল, সিলেট কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ৬:২৪:০২ অপরাহ্ন
সিলেট অফিস: গতকাল মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) দুপুর ১ টা ১৩ মিনিটের দিকে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটি কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ছিল।
তাৎক্ষণিভাবে ভূমিম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলা থেকে ১৮ কিমি দূরে বলে জানিয়েছে অ্যান্ড্রয়েড ভূমিকম্প সতর্কতা সিস্টেম।
ভূমিকম্পের কারণে নগরবাসীর মনে আতঙ্ক দেখা দেয়। নগরের বাসিন্দাদের অনেকে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন।
দুই সপ্তাহ আগে গত ১৪ আগস্ট (সোমবার) রাত ৮ টা ৪৯ মিনিটের দিকে সিলেটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। সেই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলার কাছাকাছি বলে জানা যায়। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ৫ দশমিক ৫ ছিল।
সিলেট কেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট একদিকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ‘ডাউকি ফল্ট’ থেকে মাত্র ২শ’ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অন্যদিকে ‘শাহবাজপুর ফল্ট’ও কাছাকাছি। যে কারণে সিলেটের জন্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি খুব বেশি। ফলে এখানে ৬ থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণে এ আশঙ্কা আরো বাড়ছে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন যা হওয়ার তা হচ্ছে না। আর সিলেটের আশপাশে ভূমিকম্প উৎপত্তির ফল্ট থাকায় এ অঞ্চলটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
২০২১ সালের ২৫ মে ৫ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৩৬৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অর্থাৎ সিলেটের পূর্বে। একই বছর ১৪ এপ্রিলের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের ডাউকি ফল্টের পার্শ্ববর্তী জৈন্তাপুর এলাকায়। এছাড়া ২৭ জানুয়ারি ৪ দশমিক ১ ও পরদিন ৪ দশমিক ৯ মাত্রায় ভূকম্পন অনূভত হয়।
আবহাওয়াবিদ সাঈদ বলেন, এ অঞ্চলে সাধারণত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ও মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে ভূকম্পন হয়ে থাকে। তবে ১৯১৮ সালে উৎপত্তিস্থল হিসেবে সিলেট অঞ্চলে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায়।
করণীয় কি ?
ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগ থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষার প্রয়োজনে সম্ভাব্য ভূমিকম্প মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে নিচের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
১. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
২. ভূমিকম্প মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি
৩. ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্গঠন কর্মসূচি ইত্যাদি
১. ভূমিকম্পে দালানকোঠার নিচে পড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। সম্ভাব্য ভূমিকম্পের প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে জনসচেতনতা বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন। ভূমিকম্পে জনসাধারণের করণীয় সম্পর্কে যেমন: ভূমিকম্পের আগে, ভূমিকম্পের সময় ও পরে কী করা উচিত, সে বিষয়ে অবহিত করা। তা ছাড়া ভূমিকম্প কী, কেন হয় ও এর প্রভাব; পরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ না করলে, প্রয়োজনীয় বিল্ডিং কোড মেনে না চললে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, সে বিষয়ে সচেতন করা। নিচে ভূমিকম্পের আগে, পরে ও ভূ-কম্পনের সময় সাধারণের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ভূমিকম্পের আগে কি করা উচিত?
(ক) বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন বন্ধ করার নিয়মকানুন পরিবারের সবার জেনে রাখা।
(খ) ঘরের ওপরের তাকে ভারী জিনিসপত্র না রাখা, পরিবারের সব সদস্যের জন্য হেলমেট
রাখা।
(গ) পরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণের জন্য বিল্ডিং কোড মেনে চলা। ভবনের উচ্চতা ও লোডের
হিসাব অনুযায়ী শক্ত ভিত দেওয়া, রেইন ফোর্সড কংক্রিট ব্যবহার, পাশের বাড়ি থেকে
নিরাপদ দূরত্বে বাড়ি নির্মাণ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন নিরাপদভাবে স্থাপন করা। গর্ত ও নরম
মাটিতে ভবন নির্মাণ না করা।
ভূমিকম্প চলাকালে কি করবেন ?
(ক) নিজেকে ধীরস্থির ও শান্ত রাখা, বাড়ির বাইরে থাকলে ঘরে প্রবেশ না করা।
(খ) একতলা দালান হলে দৌড়ে বাইরে চলে যাওয়া। তা ছাড়া বহুতল দালানের ভেতরে
থাকলে টেবিল বা খাটের নিচে চলে যাওয়া ও কাচের জিনিসের কাছ থেকে দূরে থাকা।
লিফট ব্যবহার না করা।
(গ) উঁচু দালানের জানালা বা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নামার চেষ্টা না করা। ভূমি ধসে পড়ার
সম্ভাবনা আছে এমন উঁচু ভূমি থেকে দূরে থাকা।
(ঘ) ভূমিকম্পের সময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
ভূমিকম্পের পরে কি করবেন ?
(ক) ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে ধীরস্থির ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বের হওয়া।
(খ) রেডিও টেলিভিশন থেকে জরুরি নির্দেশাবলি শোনা এবং তা মেনে চলা।
(গ) বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন লাইনে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, পরীক্ষা করে নেওয়া ও প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
(ঘ) সরকারি সংস্থাগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করা।
(ঙ) উদ্ধারকাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহযোগিতা করা।
২। ভূমিকম্প বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের পূর্বপ্রস্তুতি থাকা আবশ্যক। সে জন্য সম্ভাব্য ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে সঠিকভাবে নিজেকে সেবায় মনোনিবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ সব প্রতিষ্ঠানের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বর্তমান কাঠামোতে ভূমিকম্পবিষয়ক সার্বিক প্রস্তুতি অত্যন্ত নগণ্য বিধায় পূর্বপ্রস্তুতির উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক।
৩। ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার ও ত্রাণ কর্মসূচি নিশ্চিতকরণ। উদ্ধার কর্মসূচির অভাবে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে থাকে। পূর্বপ্রস্তুতি, দক্ষ প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক উদ্ধার কর্মকাণ্ডের মূল চাবি। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ/ওষুধ, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য, ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন ফায়ার ব্রিগেড, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিমানবাহিনী, রেড ক্রিসেন্ট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি চমৎকার সম্পর্ক থাকা জরুরি।
বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির অন্তর্ভুক্ত না হয়েও দুর্বল অবকাঠামো, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রয়োজনীয় বিল্ডিং কোড মেনে না চলার কারণে এবং যত্রতত্র ভবন ও স্থাপনা নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। যেহেতু ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, একে থামিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সেহেতু ভূমিকম্প পূর্বপ্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে ভূমিকম্প-পরবর্তী শক্তিশালী এবং কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এই দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকা জরুরী ।




