সিলেট : মোমিনছড়া চা বাগান বন্ধ, মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ, ৩ কোটি টাকার ক্ষতি
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ মে ২০২২, ১২:৫৯:৪৮ অপরাহ্ন
করোনাকালে এই বাগানে সাড়ে ৪ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে
হাসান চৌধুরী : সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মোমিনছড়া চা বাগান বন্ধ রয়েছে মালিক-শ্রমিক অসন্তোষের কারণে। ২৫ মে কর্তৃপক্ষ বাগান বন্ধ ঘোষণা করেন। এরপর থেকে সেখানে বিরাজ করছে উত্তেজনা। শ্রমিকরা পালাক্রমে ঘেরাও করে রেখেছে বাগানের ফ্যাক্টরি। এ নিয়ে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে। গত ৭ মে থেকে শ্রমিকরা ধর্মঘটে ছিল। দাবি আদায় নিয়ে এই ধর্মঘট। এ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হলেও কোনো সমাধান হয়নি। এ কারণে মালিকপক্ষই বন্ধ করে দিয়েছেন বাগান। বাগানের মালিকপক্ষ বলছেন, শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে প্রায় ৩ কোটি টাকার লোকসান ইতোমধ্যে হয়ে গেছে।
শ্রমিকদের দাবি বাগান খোলার। বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, গত ৭মে থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে তাদের। প্রায় ১ লাখ কেজি চা পাতা গুদামে পড়ে আছে। এর বাইরে ২৯ হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। মোমিনছড়া সিলেটের শতবর্ষী চা বাগান। শুরু ১৯১৩ সালে। ইংরেজদের হাত ধরেই যাত্রা শুরু।
বর্তমানে বাগানের মালিক হচ্ছেন লন্ডন প্রবাসী সামসুদ্দিন খান। তাজ টি অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির নামে এই বাগান পরিচালিত হচ্ছে।
চা উৎপাদনে রেকর্ড রয়েছে এই বাগানের। করোনাকালীন সময়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে এই বাগানে সাড়ে ৪ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ বাগানের চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৫ লাখ কেজি। বাগানে প্রায় ১১শ’ শ্রমিক কাজ করে। এর মধ্যে ৭০০ জন হচ্ছে স্থায়ী ও বাকি ৪শ’ জন অস্থায়ী। গত ৭মে বাগান পঞ্চায়েত কমিটির প্রধান লিটন মৃধাসহ শ্রমিক নেতারা কর্তৃপক্ষের কাছে ১৩ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। লিখিত ভাবে ওই দাবি উপস্থাপন করে তারা ধর্মঘট শুরু করে। প্রায় ১১শ’ শ্রমিক কাজ থেকে বিরত থাকে। এতে বেকায়দায় পড়েন বাগান কর্তৃপক্ষ। ধর্মঘট আহ্বান করে শ্রমিকরা বাগানের প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। ফলে পাশে থাকা ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে চা বাইরে নেয়া যায়নি। নেয়ার চেষ্টা করা হলেও শ্রমিকরা বাধা দেয়। ফ্যাক্টরিতে চা ম্যানুফ্যাকচার প্রক্রিয়া তো বন্ধ আছেই।
শ্রমিকদের দাবি হচ্ছে- দাবি মেনে নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির সুরাহা করে বাগানের কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করতে হবে। বাগানের ভেতর থেকে চা বাইরে নেয়া বন্ধ করে দেয়ার প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ সার্বিক বিষয় অবগত করে বিষয়টি লিখিতভাবে সিলেটের আঞ্চলিক শ্রমিক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে অবগত করেন। এর প্রেক্ষিতে ১৪ মে সমঝোতা বৈঠকের আহ্বান করেন শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খুরশেদ আলম। বৈঠকে শ্রমিকদের দেয়া ১৩টি দাবির মধ্যে ১২টি দাবি মালিকপক্ষ মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। অপর দাবি পরবর্তী সময়ের আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু ওই বৈঠকের নেয়া সিদ্ধান্ত না মেনে পঞ্চায়েত কমিটির সদস্যরা চলে যান।
এরপরও শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখছেন। তিনি জানিয়েছেন- ‘আমরা আবারো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছি। উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সময়ে বৈঠক আহ্বান করা হবে।’
এদিকে ১৮ দিন বাগানের সার্বিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েন বাগান কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছেন, ধর্মঘটের আগে প্রায় ১ লাখ কেজি চা পাতা বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। ওই চা পাতা ম্যানুফেকচার করা সম্ভব হয়নি। ওই চা পাতাগুলো এখন গুদামেই পঁচে যাচ্ছে। আরও ২৯ হাজার কেজি কাঁচা পাতা, যেগুলো অন্য বাগান (মাথিউরা টি স্টেট) থেকে আসে ম্যানুফ্যাকচারের জন্যে, সেগুলোও পঁচে গেছে।
এ ব্যাপারে তাজ টি অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির ডেপুটি সেক্রেটারি সাইফুল হাসান জানিয়েছেন- ‘সব মিলিয়ে গত ২২ দিনে তাদের প্রায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যে পাতাগুলো গুদামে নষ্ট হচ্ছে সেগুলোর মূল্য হবে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। বাইরের গ্রীন লিফের মূল্য প্রায় ১৭ লাখ টাকা।’ তিনি বলেন- ‘বাগানের শ্রমিকরা প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে পণ্য বাইরে আনা-নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে বাগান কর্তৃপক্ষ লোকসানের মুখে রয়েছে।’
এছাড়া বাগান কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, এবার বাগানের ভেতরে মালিকপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মূল হোতা হচ্ছেন বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির প্রধান লিটন মৃধা। তিনি বাগানের ভেতরে নিজের উদ্যোগে পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এর বাইরে দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক ৫ থেকে ৬ জনের ভুয়া হাজিরা দিয়ে টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। বাগানের টিলাবাবু মোস্তাক আহমদের যোগসাজশে ভুয়া শ্রমিকদের নামে সুযোগ-সুবিধা নেয়া হচ্ছে। বাগান কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ে ৪ঠা মে বিষয়টি ধরা পড়লে লিটন মৃধা ক্ষেপে যান। তিনি তার অপকর্ম ঢাকতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ১৩ দফা দাবি উপস্থাপন করেছেন। এই দাবির মধ্যে দৈনিক প্রতি শ্রমিকের ২৫ কেজি চা পাতা উত্তোলনকে ২০ কেজিতে নামিয়ে আনার দাবি জানানো হয়। অথচ এটি অযৌক্তিক বলে দাবি করেন কর্তৃপক্ষ। তারা বলেন- যেসব দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে এর মধ্যে ১২টি নিয়ম মেনেই বাগান পরিচালনা করছে। এ ছাড়া, বাগানের শ্রমিকদের কমমূল্যে রেশন প্রদান করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এরপরও তাদের চিকিৎসা, বাসস্থান প্রদানে কোনো গাফলতি করা হচ্ছে না। বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বগতি থাকার পরও বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের স্বার্থ বিবেচনা করে এই ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে।
তবে পঞ্চায়েত প্রধান লিটন মৃধা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন- ‘আমি এই সুবিধা পাই বলে ২-১ জনের নিতে পারি। কিন্তু এটিকে তারা বড় করে দেখছে।’ তিনি জানান, ‘যে দাবিগুলো উপস্থাপন করা হচ্ছে; সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত না করার কারণেই ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল।’
এদিকে শ্রমিকদের অবস্থানের কারণে বাগানের ভেতরে প্রতিদিনই উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে। গতকালও বাগান এলাকা পরিদর্শন করেছেন ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ওসি মো. সাফায়াত হোসেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘মালিক-শ্রমিক বিরোধের কারণে যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে কারণে পুলিশ টহলে রয়েছে। তিনি নিজেও প্রতিদিন একবার গিয়ে পরিদর্শন করে আসছেন। বিষয়টির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ সক্রিয় থাকবে বলে জানান তিনি।




