যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়া ইমরানকে বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনী ক্ষমতা থেকে সরালো
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১১ এপ্রিল ২০২২, ১:০৫:৪৬ অপরাহ্ন
মাসকাওয়াথ আহসান
ইমরান-কাণ্ডে যেন চূড়ান্তভাবে উন্মোচিত হলো- সেনাবাহিনী জনগণের বন্ধু নয়। দ্বিদলীয় পরিবারতন্ত্রের দুর্নীতির কৃষ্ণগহ্বর থেকে ইমরান খান পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন। তার নেতৃত্বে পিটিআই নামে তৃতীয় শক্তির উত্থান ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটির শেষ ভরসার জায়গা।
বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানের প্রধান দুটি দল ‘ইমরান খান হটাও’ প্রকল্প সফল করার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে নতুন মাত্রা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি যেন উন্মোচন করলেন সেই সত্য, যার প্রয়োজনীয়তা ছিল অনিবার্য। এই সত্য হচ্ছে- পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) ইমরান ক্ষমতায় আসার আগের ১০টি বছরে ‘দুর্নীতি বসন্তে’র মাধ্যমে পাকিস্তানকে তলাবিহীন ঝুড়িতে রূপান্তর করেছিল। দল দুটি জনদুর্ভোগ ও গরিব সৃষ্টির জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। তারা বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর অন্ধ সমর্থন পেয়েছে। সেনা কর্মকর্তারা হেলিকপ্টারে গিয়ে ইমরানকে পদত্যাগের অনুরোধ করেছেন। এসবের মাধ্যমে যেন স্পষ্ট হয়ে গেল, তার উপস্থিতি বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইমরান খানের সততা, তার দলের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ না থাকা- এগুলোর বিপরীতে একাংশের রাজনীতিবিদ, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর যূথবদ্ধতাকে ইমরানবিরোধী দুর্নীতিবান্ধব জোট বলে মনে হয়।
রোববার রাতে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহরে ইমরান সমর্থকরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছেন। দেশে দেশে অনাবাসী-প্রবাসী পাকিস্তানিরাও প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন।
তুরস্কের সাধারণ মানুষ ইমরান-ট্র্যাজেডিতে হকচকিত হয়ে তাদের ক্ষোভের কথা টুইটারে লিখেছেন। ইমরান খান তুরস্কে ব্যাপক জনপ্রিয়। সাধারণ তুর্কিরা ভাবাদর্শিক প্রিয় নেতাকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করতে যেমন পথে নেমেছেন, পাকিস্তানের মানুষ কি সে ধরনের কিছু করবে না! মেনে নেবে এই প্রহসন? তা হচ্ছে না।
ইমরানের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ নেই, যা নওয়াজ শরিফ ও আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগের সঙ্গে তুলনীয়। কাজেই ট্র্যাজেডির নায়ক হিসেবেই ইমরান খান এখন সবার সহানুভূতি পাচ্ছেন।
পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের অভিমতকে কখনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ভুট্টোর কারণে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন হওয়া, বেনজিরের আমলে জারদারির দুর্নীতি, নওয়াজ শরিফ ও তার ছেলেমেয়ের দুর্নীতি- এসব ঘটনার সঙ্গে তুলনা করলে মনে হবে, আইয়ুব খান ও পারভেজ মোশাররফের সেনাশাসন ইতিবাচক ফল দিয়েছে। এমন অভিজ্ঞতার অভিঘাতে এত দিন পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর একটি জনমনোরঞ্জক গ্রহণযোগ্যতা ছিল। ইমরান খানকে সরানোর পর সেই সেনাবান্ধব মানুষরাও যেন বলছেন- ‘ব্রুটাস তুমিও!’
উল্লেখ্য, রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন ব্রুটাস। এই ব্রুটাসই বিশ্বাসঘাতকতা করে সিজারের বুকে ছুরি চালিয়েছিলেন। তাতে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলেন সম্রাট। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এখন জনগণের একটি বড় অংশ ইমরান খানের বিরুদ্ধে ব্রুটাসের ভূমিকায় বিবেচনা করছে।
ইমরান-কাণ্ডে যেন চূড়ান্তভাবে উন্মোচিত হলো- সেনাবাহিনী জনগণের বন্ধু নয়। দ্বিদলীয় পরিবারতন্ত্রের দুর্নীতির কৃষ্ণগহ্বর থেকে ইমরান খান পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন। তার নেতৃত্বে পিটিআই নামে তৃতীয় শক্তির উত্থান ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রটির শেষ ভরসার জায়গা। সেখানে দু’জন সেনা কর্মকর্তার জেমস বন্ডের মতো হেলিকপ্টারে গিয়ে ইমরান খানকে পদত্যাগে বাধ্য করানোর ঘটনা হতাশ করেছে পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষকে। বিশেষ করে পাকিস্তানের তরুণরা এখন জনসংখ্যার বড় অংশ। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইমরানের পক্ষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তারা লিখছেন, নতুন নির্বাচন হলে জীবনের প্রথম ভোটটি তারা ইমরান খানকেই দেবেন।
পিপিপি ও মুসলিম লীগের (এন) আত্মমুখী, পরিবারতান্ত্রিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি, আখের গোছানো ও সেকেন্ড হোমে টাকা পাচারের যে রাজনীতি- এগুলো তাদের জনগণের কাছে অজনপ্রিয় করে তুলেছে।
সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের যৌথ সামরিক অভিযানের ফল খুব খারাপ হয়েছে। যেভাবে দেশের মানুষ শুধু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দোজখ যন্ত্রণা পেয়েছে ও মাশুল হিসেবে জীবন দিয়েছে, তাতে কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব পাকিস্তানে সর্বোচ্চ। এমন সময় ইমরান খানকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় থাকার বিষয়টি পিপিপি ও মুসলিম লীগকে (এন) বিদেশি প্রভুর অনুগত দল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর বশ্যতা স্বীকার না করায় সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের মতো যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়েছেন ইমরান খান।
আপাতত ইমরান খান ক্ষমতা থেকে সরে গেলেও বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রাজনীতির নতুন ইনিংসে তিনি ঠিক কী করবেন, সেটি কৌতূহলের বিষয়। তবে সেনাবাহিনী অতীতের মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে তার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করলে ফল ভালো হবে না- এটি বলাই যায়। তা করলে গণশত্রুতে পরিণত হবে সেনাবাহিনী।
কাজেই ইমরান খান স্পষ্টই দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান আন্দোলনের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা একজন জনপ্রিয় আইকন। তারই কারণে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে’র তকমা পাওয়া পাকিস্তান বিশ্বপরিমণ্ডলে নতুন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পেরেছে। ফলে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়িদের’ ক্ষমতামুখী ক্লিশে খেলাধুলার বাজারমূল্য কতটা, তা সামনে দেখার বিষয়। (সমকালের সৌজন্যে)




