টিপু হত্যা রহস্য উদঘাটনে অগ্রগতি
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মার্চ ২০২২, ১১:১৫:১৯ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক : দেশের রাজধানীতে ব্যস্ততম সড়কে ফিল্মি স্টাইলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে অনেকটা এগিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা।
কারা কী জন্য টিপুকে হত্যা করেছেন, তা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে শুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশকে রিমান্ডে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে। এজন্য মতিঝিল, খিলগাঁও, পল্টন, শাজাহানপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ২ ডজন নেতাকে ডিবিতে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একই সঙ্গে মাসুমের মোটরসাইকেলচালক মোল্লা শামীম ও কিলিং মিশন পরিচালনাকারী মুসাকে গ্রেফতার করতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ডিবি।
এদের একজনের অবস্থান ঢাকাতেই বলে নিশ্চিত হতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। এই দুজনকে গ্রেফতার করা গেলে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেলের খোঁজ পাওয়া যাবে। উন্মোচিত হবে হত্যা রহস্য-এমন আশা তদন্তকারীদের।
হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই জড়িতদের গ্রেফতারে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে ছায়া তদন্তে থাকা এলিট ফোর্স র্যাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া এই বাহিনীটি দেশজুড়ে আলোচিত জোড়া খুনের হত্যা রহস্য উন্মোচন করে ইতিবাচক ইমেজে ফিরতে চায়। কিন্তু এরই মধ্যে মূল শুটার মাসুমকে ডিবি গ্রেফতার করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করায় তাদের সে চেষ্টায় একটা ধাক্কা লাগে। এরপরও তারা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ অবস্থায় সন্দেহভাজনদের নিয়ে ডিবি ও র্যাবের মধ্যে চলছে তৎতপরতা। এমনও ঘটনা ঘটছে, ডিবি ডিজ্ঞাসাবাদের পর যাদের ছেড়ে দিচ্ছে, তাদের ডেকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র্যাব। আবার ডিবির কাছে অবস্থানকালীনও অনেককে ফোন করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকছে র্যাব।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তদন্তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আমরা প্রথম টার্গেট পূরণ করেছি। শুটারকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এর বাইরেও অনেককে ডেকে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে সবকিছু বলা যাবে না। হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও দুজনের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে শুটারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেকদিন পর একটি সেনসেটিভ মার্ডারের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার রহস্য উন্মেচন ও জড়িদের গ্রেফতার করে বাহবা নিতে চাচ্ছে সবাই। র্যাব যদি কোনো বাড়তি তথ্য পায়, তার সঙ্গে যদি পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকে, সেগুলো আমাদের দিলে আমরা অবশ্যই গ্রহণ করব। যৌথভাবে কাজ করলে তো কোনো ক্ষতি নেই। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনাই বড় কথা।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ধাপে জড়িত বলে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তি র্যাবের গোয়েন্দা জালে রয়েছে। তাকে ঘিরেই হত্যা রহস্যের জট খুলতে চায় র্যাব। সংস্থাটির শক্তিশালী গোয়েন্দা শাখার প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করতে এরই মধ্যে তারা অনেককেই হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদের পর কাউকে কাউকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কারও মোবাইল ফোন জব্দ করে রাখা হয়েছে। কয়েকজনকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, ২৪ মার্চ রাতে শাজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই ঘটনায় ঘাতকের গুলিতে নিহত হন রিকশারোহী পথচারী কলেজছাত্রী প্রীতি। গুলিতে আহত হন টিপুর মাইক্রোবাসের চালক মনির। তবে মাইক্রোবাসের পেছনের সিটে বসা টিপুর বন্ধু আবুল কালাম ও মিজানুর রহমান মিরাজ অক্ষত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনায় শাজাহানপুর থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্তভার স্থানান্তর করা হয় ডিবিতে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাত দিনের রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনে জিজ্ঞাসাবাদে শুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশের অপরাধজগতের বেশকিছু তথ্য জানতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। টিপু হত্যাকাণ্ডের আগেও ভাড়ায় মানুষ খুনের মিশনে অংশ নিয়েছে সে। ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল শান্তিনগর ইস্টার্ন মার্কেটের পেছনে ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবীবুর রশীদ হাবিবকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা চালায় মাসুম। সাবেক ছাত্রদল নেতা গোলাম জাকারিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে হাবিবকে হত্যার চুক্তি নিলেও ওই কাজে ব্যর্থ হয়েছিল সে। হাবিব হত্যাচেষ্টা মামলায় জাকারিয়া ছাড়াও তার দুই সহোদর গোলাম কিবরিয়া ও গোলাম শাহরিয়ার আসামি। এছাড়াও ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর কদমতলা ব্রিজের নিচে নৃশংসভাবে সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক শরীফকে হত্যা করা হয়। ওই মামলার এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি মাসুম। জিজ্ঞাসাবাদে মাসুম জানায়, জাকারিয়া ও তার দুই সহোদর এই খুনেরও পরিকল্পনা করে তাকে ভাড়ায় ঠিক করেছিল। অনেক আগে থেকেই ঠান্ডামাথার খুনি মাসুম। তার দেওয়া এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, টিপু হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন ও মোটিভ নিশ্চিত হতে কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান অনেক স্থানীয় নেতাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা নেতাদের তালিকা বেশ লম্বা। সোমবার রাতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদারকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর আগে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ হাসান মনসুর, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাহবুবর রহমান টিটু, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সোহেল শাহরিয়ার ও শাজাহানপুর থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফরহাদ হোসেন অঙ্কুরসহ অনেকেই। হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার কথা স্বীকার করে জানান, নিহত টিপুর সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল? হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিনি কিছু আন্দাজ করতে পারেন কি না? এমন বেশকিছু প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। তিনি বলেন, এমনভাবে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ আমার জন্য বিব্রতকর। যেহেতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি স্পর্শকাতর, সেহেতু কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের আগে আরও সুনির্দিস্ট হওয়া দরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে, ডিবি যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছে তাদের প্রায় সবাইকেই ফের র্যাব হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখনো কাউকে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ হাসান মনসুরের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি জানান, ডিবি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়ার পর তাকে হেফাজতে নেয় র্যাব। ৪২ ঘণ্টা আটকে রেখে তাকে হত্যাকাণ্ডের নানা বিষয়ে জানতে চান। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুচলেকা নিয়ে সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হলেও তার মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদের পর এবার র্যাব হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ারকে। তার সঙ্গে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ঘনিষ্ঠতা এবং টিপুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। এছাড়াও ১১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান বাবুলসহ বেশ কয়েকজনকে র্যাবের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এদিকে টিপুর স্ত্রী ডলি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় বিদেশে পলাতক কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও কারাবন্দি সাবেক দুই যুবলীগ নেতার জড়িত থাকার বিষয়টিও ইঙ্গিত করেছেন। একই সঙ্গে রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবু হত্যা মামলার আসামিরা তার স্বামী খুনের ঘটনায় জড়িত থাকতে পারেন বলে স্পষ্ট করেছেন। তিনি হত্যাকাণ্ডের জড়িতদের পাশাপাশি পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। মঙ্গলবার নিজ বাসায় সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে সোমবার রাতে উত্তরার প্রধান কার্যালয়ে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন ডলি।
ঊর্ধ্বতন একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সিআরপিসিতে স্পষ্ট করেই বলা আছে-দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো তদন্ত সংস্থা ছাড়া অন্য কারও মামলার সন্দেহভাজন আসামি ধরার কোনো এখতিয়ার নেই। কিন্তু র্যাব হরহামেশাই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আসামি গ্রেফতার করায় সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো দুর্বল হয়। ফলে আদালতে আসামিদের সাজা নিশ্চিত করা যায় না।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক একটি গণমাধ্যমকে বলেন, আইনে অনেক কথা লেখা আছে। কিন্তু কেউ এখন আইনের ধার ধারে না। সন্দেহভাজন আসামিদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করার দায়িত্ব পুলিশের। এখন র্যাবও সেটা করছে। টিপু হত্যা মামলা তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসাবে ডিবি কাজ করলেও অন্য একটি সংস্থা সন্দেহভাজনদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে খবর বেরুচ্ছে। এটা সচরাচর দেখা যায় না। সূত্র : যুগান্তর, ইত্তেফাক