নজরুল গোঁড়া হিন্দু মুসলমানের সমালোচনা করতেন কেন?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪:১৪ অপরাহ্ন
:: সারওয়ার চৌধুরী ::
নজরুল সেইসব মোল্লাদের সমালোচনা করতেন যারা ইকবালের ‘শিকওয়া’ পড়ে ইকবালকে কাফের বলতেন। তাদের মেধাতে কুলায় না শিকওয়ার জবাব লেখা। ইকবালই পরে ‘জওয়াব এ শিকওয়া’ লিখেন, তখন ঐ মোল্লারা ইকবালকে খেতাব দেন আল্লামা। নজরুলকেও ওরা কাফের বলছিলেন।
▶️ কাজী নজরুল ইসলামের জীবন নানাবিধ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে। এই যাওয়াই তার নিয়তি বলা কি যায় না? তিনি শ্যামাসংগীত ভজন লিখেছেন। মন্দিরে গেছেন। মুর্শিদাবাদের বরদাচরণ মজুমদারকে গুরু মেনেছিলেন, কালীর প্রতিমা স্থাপন করে পূজাও করেছেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব মসজিদে বন্দেগি করেছিলেন। এসব হলো অনুসন্ধিৎসু মনের নানা ঘটনা প্রবাহের ভেতর দিয়ে যাওয়া। কোনো টুকরো ঘটনা বা কথা বা লেখাতে সমগ্র থাকে না।
চুরুলিয়ার দুখু মিয়া কাজী নজরুল ইসলাম নেহায়েত গরিব মানুষ কাজী ফকির আহমেদের ছেলে ছিলেন। এই দুখু মিয়ার সারাটা জীবন গভীরতর দুঃখভরা ছিল। এ দুখু মিয়া শতাব্দীর শীর্ষে উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হওয়া সত্ত্বেও দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবন যাপন করে গেছেন। ১৯৪২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত ৩৪ বছর নির্বাক অসুস্থ ছিলেন। এই নজরুল মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন, মক্তবের শিক্ষক ছিলেন, রুটির দোকানের সহকারী ছিলেন, রেলওয়ে গার্ডের ভৃত্য ছিলেন, দারোগার বাড়ির কাজের লোক ছিলেন। যাত্রা দল ‘লেটোর দল’ এর পালা লেখক গায়ক নর্তক ছিলেন। এ দুখু মিয়া বিশ্বযুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ করেন নি। রিজার্ভ সৈন্য আকারে ছিলেন শিবিরে। শিবিরে সৈন্যদের নিয়মিত চর্চা-টর্চাতে মনোযোগ নাই। গান গাইতেন, লিখতেন। কবিতা গল্পও লিখতেন। সেনাশিবিরে বসেই লিখেন— ‘শাতিল আরব’ ‘খেয়া পারের তরণী’ ‘মহররম’ ‘কোরবানি’ ইত্যাদি।
কাজী নজরুল ইসলাম গোঁড়া হিন্দু গোঁড়া মুসলমানের সমালোচনা করতেন। গোঁড়া কারা? যারা ধর্মের ইনার স্পিরিট বোঝেন না। যাদের কাছে ধর্মের সারাৎসার নাই। কেবল অল্প উপরি-উপরি জ্ঞান নিয়ে হাঙ্গামা করে, বিদ্বেষ ছড়ায়, হানাহানি করায়; নজরুল সেইসব মোল্লাদের সমালোচনা করতেন যারা ইকবালের ‘শিকওয়া’ পড়ে ইকবালকে কাফের বলতেন। তাদের মেধাতে কুলায় না শিকওয়ার জবাব লেখা। ইকবালই পরে ‘জওয়াব এ শিকওয়া’ লিখেন, তখন ঐ মোল্লারা ইকবালকে খেতাব দেন আল্লামা। নজরুলকেও ওরা কাফের বলছিলেন। তাছাড়া যেসব নামাজি নামাজ পড়ে পাঁচ ওয়াক্ত, কিন্তু তাদের আমল আখলাক ভাল না, সততা নাই। মিথ্যা বলে, ফিৎনা লাগায়, মুনাফালোভী, সব ধরনের অন্যায় করে, অন্তর পরিচ্ছন্ন হয় না তাদের নামাজে, কাম ক্রোধ লোভ মোহে ডুবে থাকে, সেইসব নামাজির সমালোচনা করতেন নজরুল।
তিনি বিস্তর পড়াশোনা করতেন। তৎকালীন বিশ্বের সাহিত্যের ব্যাপারেও আপডেট ছিলেন। উর্দু ফারসিতে ইসলামের অন্তর্নিহিত বার্তা বুঝেছেন। কোরানের আটত্রিশটি সুরার অনুবাদ করে ‘কাব্য আমপারা’ প্রকাশ করেন। বইটি আলেমদের উদ্দেশে নিবেদন করে নিজেকে জানান ‘খাদেমুল ইসলাম’।
তিনি লিখেছেন—
“দুনিয়াদারীর শেষে আমার নামাজ রোজার বদলাতে/চাই না বেহেশত খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত ক’রে/খোদার প্রেমে শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে..”
পারস্যের বিশাল ইলমে তাছাউফ বা ইসলামের আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্ভার পড়ে নজরুল বুঝেছিলেন— “আসলে এ সমুদয়ের মাঝে সবচেয়ে বড় হল আল্লাহর সন্তুষ্টি। (সুরা তাওবা, আয়াত ৭২) বুঝেছিলেন “And do not insult those whom they call upon besides Allah. Quran 6:108। মানে, তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। নজরুল বুঝেছিলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, অন্তর পরিশুদ্ধ করবার ধর্ম। ইসলাম হিংসা বিদ্বেষমুক্ত হওয়ার পাঠ দেয়। তাই অছিয়ত করেছিলেন— “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই”। তার প্রার্থনা কবুল হয়েছিল বলেই মসজিদের পাশেই তার কবর হয়। খেয়াল করার বিষয়, কেবল মসজিদের বলেন নি, বলেছেন ‘মসজিদেরই’। ই প্রত্যয় যুক্ত করে বলার মানে কি? এমফাসিস দিয়ে বুঝিয়েছেন এই আমার ধর্মের এবাদতগাহ।
তার লেখা ‘আমার ধর্ম’ মিনি প্রবন্ধটির পার্টিকুলারিজম বিবেচনায় না নিয়ে ঢালাওভাবে নজরুল কোনো ধর্মে ছিলেন না বলা অন্যায্য, খণ্ডিত বিবেচনা হয়; মিথ্যারোপ হয় বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে যাওয়া এ অসাধারণ মানুষটির ওপর।
(সারওয়ার চৌধুরী লিখিত ‘নজরুলের হিন্দু মুসলিম ঐক্য প্রয়াস ও তাঁর ‘আমার ধর্ম’ লেখার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ থেকে অংশ বিশেষ)
সারওয়ার চৌধুরী : কবি, কলামিস্ট, অনুবাদক, নির্বাহী সম্পাদক : অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর