অন্তরের চোখে আল্লাহ দেখতে পাওয়া
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১১ এপ্রিল ২০২৪, ১:২১:২৮ অপরাহ্ন
:: সারওয়ার চৌধুরী ::
মাথায় তো মেমরি আছেই, হৃদয়েরও মেমরি আছে। দুই মেমরি পুরো শরীরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে শলা-পরামর্শ বা গপসপ করে
▶️ আমাদের শরীরের চোখে দেখা যাবে কি আল্লাহ? না মনের চোখে দেখা যাবে? মনের চোখে দেখা ব্যাপারটা কেমন? আল্লাহকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রধান ইন্দ্রীয় চোখের মাধ্যমে দেখতে না পারা বিষয়ে কিছু দলিল—
অলাম ইয়া কুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ — আর তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই — Nor is there to Him any equivalent. Quran 112:4 মানে, আমাদের চোখে দেখা জগতের কোনো কিছুর সাথে আল্লাহর তুলনা হয় না।
আর বললেন, ‘লা তুদরিকুহুল আবসার’ — দৃষ্টিসমূহ তাঁকে পেতে পারে না — no vision can grasp him. Quran- 6:103. মানে, দর্শনেন্দ্রিয়ের দ্বারা তাঁকে দেখার সাধ্য নাই।
(মুসাকে আঃ আল্লাহ বলেছেন) লান তারা নী — তুমি আমাকে দেখতে পাবে না — you will not see me. 7:143 পরে তো পাহাড়ে জ্যোতির ঝলক রুপে দেখা দিতেই মুসা আঃ হুঁশ হারালেন।
রসুল সঃ বলেছেন, পুনরুত্থানের দিন তোমরা কেবল তাঁকে পরিস্কার দেখতে পাবে। ( you will see Him just as clearly on the day of resurrection. Al Bukhaari-6088) এবং জেনে রাখো মৃত্যুর আগে তোমাদের কেউ তোমাদের প্রভুকে দেখবে না। (Know that none of you will see your lord until he dies. Muslim-5215)
একটা দলিল এ রকম—
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, কেউ তার প্রভূকে স্বপ্নে দেখতে পারে নানা রুপে তার আস্থা ও বিশ্বাস অনুযায়ী। তার ঈমান যদি সঠিক হয়, সুন্দর কোনো আকৃতিতে আল্লাহকে দেখতে পারেন। যদি তার ঈমান কমজোর হয়, সেটাও প্রকাশ পাবে তিনি যেভাবে তাঁকে দেখবেন। আল্লাহকে স্বপ্নে দেখা মানে আল্লাহ বাস্তবে দেখে ফেলা নয়। (Shaykh al-Islam Ibn Taymiyah said, A believer may see his Lord in a dream, in various forms according to his faith and belief. If his eemaan is correct, he can only see Him in a beautiful form, and if his faith is lacking, this will be reflected in the way he sees Him. Seeing Allah in a dream is not like seeing Him in reality. (al-Fataawa, 3/390)
স্বপ্ন মানে, ঘুমে দেখা স্বপ্ন আসলে কী এখনো কেউ যথাযথভাবে বলতে পারেন নি। ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণসহ, কার্ল ইয়ুঙের কালেক্টিভ আনকনশাস ধরেও সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় নি স্বপ্ন আসলে কী। বহু ব্যাখ্যা বহু তত্ব এসেছে তবু রহস্যাবৃত ড্রিম ও ড্রিম ইন্টারপ্রিটেশনস।
আব্দুল কাদের জিলানি রহঃ একবার স্বপ্নে দেখলেন পানিতে সিংহাসনে বসা এক লোক নিজেকে আল্লাহ পরিচয় দিয়ে বলছে— আমি তোমার আল্লাহ। এখন থেকে তুমি যা খুশি করো, আমার কোনো আদেশ নিষেধ মানা লাগবে না তোমার। জিলানি রহঃ বুঝে ফেলেন এ তো শয়তান। বলেন, দূর হও, তুমি শয়তান। আল্লাহর আদেশ নিষেধ সকলের জন্যে, কারো জন্যে বাতিল করার ব্যাপার নাই।
এ পর্যন্ত দেখা গেল, আল্লাহকে আমাদের কপালের নিচের দুই চোখে দেখা সম্ভব নয়। হৃদয়ের চোখে দেখা ব্যাপারটা তাহলে কী আসলে?
হার্ট হলো সেই জিনিস, যার কাজ ঠিকমতো চলতে থাকলে জীবন ও জীবনের উপলব্ধি সুন্দর মনোহর বিস্ময়কর হয়। সহজ কথায়—হৃদয় ভাল তো মন ব্রেইনসহ সব ভাল। হৃদয় অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত মাথায় ও শরীরের সবখানে সরবরাহ করে বলেই পুরো বায়োমিকানিজম চমৎকার কাজ করে এবং চমৎকার কাজ করে বলেই হার্ট নিজেও বরাবর পাম্প করতে পারে। ব্রেইনের সাথে হার্টের সম্পর্ক আছে। ব্রেইন সিগনাল দেয় হার্টকে অক্সিজেন-রিচ ব্লাড সাপ্লাই দিতে। গবেষণা দেখালো, যদি মাত্র ছয় মিনিট হৃদয় ব্লাড সাপ্লাই বন্ধ রাখে, ব্রেইন সেল মরে যাওয়া শুরু। (lack of oxygen can cause brain cells to die.)
হৃদয় আর মস্তিষ্কের অতুলনীয় সংযোগে রচিত ভাষা ছিল মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির কবিতার ভাষা, আলাপের ভাষা। তাঁর হৃদয়ের ভাষা তাই যুগ যুগ ধরে অনিন্দ্য, অনুপম বিশ্বব্যাপে
হার্টের যত্ন নেয়া মানে ব্রেইনের যত্ন নেয়া। যা হৃদয়ের জন্যে ভাল তা মস্তিষ্কের জন্যে ভাল। বর্ণবাদ বিরোধী প্রখর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন— ‘A good head and a good heart are always a formidable combination.’ অর্থাৎ ভাল হৃদয় ও ভাল মস্তিষ্ক অসাধারণ সংযোগ তৈরী করে।
মাথায় তো মেমরি আছেই, হৃদয়েরও মেমরি আছে। দুই মেমরি পুরো শরীরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে শলা-পরামর্শ বা গপসপ করে। (a heart brain composed of about 40,000 neurons that can sense, feel, learn and remember.) হৃদয়ের আছে কোনো কিছু জানার রহস্যময় তরিকা (মিস্ট্রিয়াস ওয়ে অব নোয়িং)। হৃদয় মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করতে পারে ভাল সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায়। তাছাড়া মানুষের স্বজ্ঞার সামর্থ হৃদয়ের প্রভাব নির্ভর।
ইসলামে হৃদয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে-হৃদয় আল্লাহর ভালবাসাভরা, সে-হৃদয় প্রশান্ত সুন্দর, সে-হৃদয় সকলের জন্যে, সকল কিছুর জন্যে মঙ্গলকর। কোরআনের ২৬:৮৯ আয়াতে পরিচ্ছন্ন অন্তরের (ক্বালবিন সালিম) কথা বলা হয়েছে, যে-অন্তর আল্লাহর সামনে সফল হয়ে আসবে বিচার দিবসে।
রসুল সঃ বলেছেন হৃদয় সম্পর্কে: নিশ্চয়ই শরীরে এক টুকরো মাংস এমন আছে, যেটি সুস্থ থাকলে সমগ্র শরীর সুস্থ, যেটি অসুস্থ হলে সমগ্র শরীর অসুস্থ হয়, সেটি হল হৃদয় আসলে। (Truly in the body there is a morsel of flesh which, if it be sound, all the body is sound and which, if it be diseased, all of it is diseased. Truly it is the heart. [al-Bukhaaree, Muslim]
আমরা জেনেছি, ইসলাম শিখিয়েছে, কাম ক্রোধ হিংসা লোভ…ইত্যাদি ছয় রিপু অন্তরকে কলুষিত করে, ময়লা করে। এবাদতের দ্বারা ময়লা দূর করতে হয়। পরিচ্ছন্ন অন্তরে ওসব থাকে না বলেই সেটা পরিচ্ছন্ন অন্তর।
অন্তর পরিচ্ছন্ন করবার দোয়া আল্লাহ শেখাচ্ছেন কোরআনে এভাবে—
رَبَّنَا لَا تُزِغۡ قُلُوۡبَنَا بَعۡدَ اِذۡ هَدَيۡتَنَا وَهَبۡ لَنَا مِنۡ لَّدُنۡكَ رَحۡمَةً ۚ اِنَّكَ اَنۡتَ الۡوَهَّابُ
মুসলমানদের বহুপঠিত প্রার্থনা এটি— রাব্বানা লা তুজিগ ক্বুলুবানা বা’দা ইজ হাদাইতানা ওয়া হাবলানা মিল্লা দুনকা রাহমা, ইন্নাকা আনতাল ওয়াহহাব। সুরা আল ইমরান, আয়াতঃ ০৮, অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা, সরলপথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে বাঁকা করে দিও না এবং তুমি আমাদের প্রতি করুণা কর, তুমিই মহান দাতা। (Our Lord, let not our hearts deviate after You have guided us and grant us from Yourself mercy. Indeed, You are the Bestower.Quran, Al Imran, ayat 08)
ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেছিলেন মানুষের চিন্তা ও উপলব্ধির কেন্দ্র আসলে হৃদয়। (“Ibn Taymiyyah rahimahullaah said that many doctors and philosophers have said that the mind is in the brain, so we think and understand with our brains and not with our hearts. He then said that the centre is actually the heart.”)
বিশ্বাস করতে, অবিশ্বাস করতে, বুঝে নিতে, উপলব্ধি করতে প্রশান্তি পেতে, সন্দিহান হতে; একাগ্র হতে, আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে, এ সবকিছুতে সক্রিয় থাকে হৃদয়। উল্লেখ্য, হৃদয় আর মস্তিষ্কের অতুলনীয় সংযোগে রচিত ভাষা ছিল মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির কবিতার ভাষা, আলাপের ভাষা। তাঁর হৃদয়ের ভাষা তাই যুগ যুগ ধরে অনিন্দ্য, অনুপম বিশ্বব্যাপে।
এই অন্তর — এই হৃদয়, যে-হৃদয় মাথার ব্রেইনের সাথে সংযুক্ত, এতে এক অদ্বিতীয় সুপ্রিম বিঙ বিষয়ক ভাবনা (ইতিবাচক বা নেতিবাচক) আসে কেন? আল্লাহ তাঁর ফিতরাতের (প্রকৃতি) উপর মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলে জানিয়েছেন কোরআনের সুরা রূম ৩০:৩০ আয়াতে। “অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।” এই the innate religious disposition—that he himself experienced—as an urge for people to “seek knowledge of the reality of things.” (আল মুনক্বিদ মিনাল দালাল — ইমাম গাজ্জালির অটোবায়োগ্রাফি)
কপালের নিচের চোখ, যে-চোখ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়, এই চোখে আল্লাহকে দেখতে না পারলেও হৃদয়ের চোখে দেখবার বা উপলব্ধি করবার ব্যাপারটি থাকছে এ রকম—
যুক্তি-জ্ঞানের স্তর অতিক্রম করে আরেক স্তর যেখানে অন্য এক চোখ খুলে, যে-চোখ মনশ্চক্ষু, যে-মনশ্চক্ষে অদৃশ্য পরমকে দেখবার পরিজ্ঞান পাওয়া যায়, পাওয়া যায় অন্য বিষয়-আশয়ে ভবিষ্যতে ঘটবে এমন ঘটনার উপলব্ধি। —‘Beyond the level of reason lies another level that opens another eye by which one gains insight into the Unseen and into what will occur in the future, among other things.’ (আল মুনক্বিদ মিনাল দালাল — ইমাম গাজ্জালির অটোবায়োগ্রাফি)
একজন খালেস মনোযোগি বান্দাহ বলেছিলেন, তিনি যখন প্রার্থনাতে বেকারার হন, কাঁদেন, সেজদায় ডুবে যান, তখন আল্লাহকে উপলব্ধিতে পান, তখন তিনি নিজেকে প্রাণবন্ত দেখেন।
ওয়াল ইলমু ইন্দাল্লাহ — আল্লাহ ভাল জানেন, নিশ্চয়ই তিনি মহাজ্ঞানী।
সারওয়ার চৌধুরী: কবি, কলামিস্ট, অনুবাদক, নির্বাহী সম্পাদক- অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর