কেন বারবার সংঘাতে জড়াচ্ছে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ৮:৫৫:৩৫ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বিতর্কিত সীমান্তে আবারও সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। গত সোমবার ভোরের আগ থেকেই সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে হামলা শুরু হয়। পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে গেলে থাইল্যান্ড কম্বোডিয়ার সামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। সংঘাতের জন্য দুই দেশই পরস্পরকে দায়ী করছে।
গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল। বর্তমান সহিংসতা সেই চুক্তির স্থায়িত্বের জন্য বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
থাই সেনাবাহিনী জানায়, সোমবার ভোর হওয়ার আগেই সীমান্তের পাঁচটি স্থানে সংঘর্ষ শুরু হয়। তাদের অভিযোগ, কম্বোডিয়ার বাহিনী বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করে বিএম-২১ রকেট ছুড়েছে। পাশাপাশি থাই ঘাঁটিগুলোর ওপর গ্রেনেড লঞ্চার, আর্টিলারি ও ড্রোন ব্যবহার করে বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয়েছে। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের বাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তবে তারা পাল্টা আক্রমণ করেনি এবং থাইল্যান্ডের ‘উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ সত্ত্বেও যুদ্ধবিরতি মেনে চলার দাবি করেছে।
থাইল্যান্ডের বিমানবাহিনী নিশ্চিত করেছে, তারা সোমবার সকালে কম্বোডিয়ার সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে। তাদের দাবি, কম্বোডিয়া সীমান্তে ভারী অস্ত্র ও সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং কম্বোডিয়ার সামরিক সক্ষমতা কমাতে এই ‘প্রতিরোধমূলক হামলা’ চালানো হয়েছে বলে জানানো হয়।
লড়াইয়ে সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কম্বোডিয়া সরকার বলছে, ওডার মিনচে প্রদেশ থেকে ১ হাজার ১৫৭টি পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, যিনি আগের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সহায়তা করেছিলেন, দুপক্ষকেই শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, উত্তেজনা না কমালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি পুরোপুরি ভেঙে যেতে পারে।
সংঘাতের প্রেক্ষাপট কী: জুলাই মাসে পাঁচ দিন ধরে চলা রকেট ও ভারী কামানের গোলাবর্ষণের পর দুই দেশের মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুতর সংঘাত। সাম্প্রতিক ইতিহাসের ওই ভয়াবহ লড়াইয়ে অন্তত ৪৮ জন নিহত হন এবং ৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়।
এবারের অশান্তির তাৎক্ষণিক কারণ স্পষ্ট নয়। তবে ১০ নভেম্বর একটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে একজন থাই সেনা আহত হওয়ার পর থেকেই উত্তেজনা বাড়ছিল। মালয়েশিয়ায় ট্রাম্পের উপস্থিতিতে হওয়া শান্তি চুক্তি ওই ঘটনার পর থাইল্যান্ড স্থগিত করে। থাইল্যান্ডের দাবি, ল্যান্ডমাইনটি নতুন করে কম্বোডিয়া পুঁতেছিল এবং ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তারা শান্তি প্রক্রিয়ায় ফিরবে না।
কিন্তু কম্বোডিয়া বারবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গত মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প দুই দেশের নেতাদের ফোন করে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার আহ্বান জানান।
দুই দেশের সামরিক শক্তি: সামরিক সক্ষমতায় থাইল্যান্ড প্রতিবেশী কম্বোডিয়ার তুলনায় অনেক এগিয়ে। থাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বাজেট কম্বোডিয়ার চেয়ে চারগুণ বেশি, আর সক্রিয় সেনা সংখ্যাও তিনগুণ।
কম্বোডিয়ার সেনাবাহিনীতে রয়েছে ৭৫ হাজার সেনা, ২০০টির বেশি যুদ্ধট্যাংক এবং প্রায় ৪৮০টি আর্টিলারি বা কামান। অন্যদিকে থাইল্যান্ডের সেনাসদস্য ২ লাখ ৪৫ হাজার। তাদের কাছে প্রায় ৪০০টি ট্যাংক, ১ হাজার ২০০টির বেশি সাঁজোয়া যান এবং ২ হাজার ৬০০টি আর্টিলারি রয়েছে।
এ ছাড়া থাইল্যান্ডের বিমানবাহিনীর হাতে প্রায় ৪০টি যুদ্ধবিমান ও বহু হেলিকপ্টার আছে; কম্বোডিয়ার কোনো যুদ্ধবিমান নেই, আছে মাত্র ১৬টি মাল্টি-রোল হেলিকপ্টার।
বিরোধের কারণ: থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থলসীমান্তের মালিকানা নিয়ে এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বিরোধ চলছে। ১৯০৭ সালে কম্বোডিয়া ফরাসি উপনিবেশ থাকাকালে ফ্রান্স এই মানচিত্র তৈরি করে, যা পরে থাইল্যান্ড চ্যালেঞ্জ জানায়। ২০০০ সালে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি কমিশন গঠিত হলেও তাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
আরও পড়ুন ⤵
ঐতিহাসিক স্থাপনার মালিকানা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা রয়েছে। ২০০৩ সালে অ্যাংকর ওয়াট মন্দির নিয়ে এক থাই তারকার কথিত মন্তব্যকে কেন্দ্র করে নমপেনে থাই দূতাবাসে আগুন দেওয়া হয়েছিল। বিরোধের কেন্দ্রে রয়েছে একাদশ শতাব্দীর হিন্দু মন্দির ‘প্রাহ ভিহিয়ার’ (থাইল্যান্ডে যা খাও ফ্রা ভিহার্ন নামে পরিচিত)।
১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক আদালত মন্দিরটি কম্বোডিয়াকে প্রদান করলেও, থাইল্যান্ডের আশপাশের জমির মালিকানা দাবি করে আসছে। ২০০৮ এবং ২০১১ সালে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে।
এ বছরের সমস্যার নেপথ্যে কী: ২০২৪ সালে সমুদ্রের জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানে যৌথ আলোচনা শুরু হলে থাইল্যান্ডে জাতীয়তাবাদী আবেগ তীব্র হয়ে ওঠে। রক্ষণশীল মহল সতর্ক করে জানায়, এর ফলে থাইল্যান্ড তাদের দ্বীপের ভূখণ্ড হারাতে পারে।
চলতি বছরের মে মাসে এক সংঘর্ষে থাই বাহিনীর গুলিতে এক কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হলে সীমান্তজুড়ে সেনা বৃদ্ধি করা হয়। এই সীমান্ত উত্তেজনার বড় প্রভাব পড়ে থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে। আগস্টে আদালতের আদেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পেতংদার্ন সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। কম্বোডিয়ার প্রভাবশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে তার একটি গোপন ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় জনরোষ তৈরি হয়, আর পরিস্থিতি শান্ত করার প্রচেষ্টা উল্টো বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। (সূত্র: বিবিসি ও রয়টার্স )


