লন্ডনে মাসব্যাপী বিজয়ফুল কর্মসূচির শুভ উদ্বোধন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫:৪৯:১২ অপরাহ্ন
‘’ডিসেম্বর মাস, বাংলাদেশের বিজয়ের মাস। বিশ্বের যেখানেই থাকুন বিজয়ের মাসে প্রতিদিন বিজয়ফুল পরুন, বিজয়ের গৌরবে সমুন্নত থাকুন এবং ‘৭১ এর শহীদদের স্মরণ করুন আর বাংলাদেশের বিজয়কে বুকে ধারণ করুন’’
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, লন্ডন: মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই বেগবান করার অঙ্গিকার নেয়ার মধ্য দিয়ে লন্ডনে বিজয়ফুল কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে।
কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারের পাদদেশে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় ৩০শে নভেম্বর সন্ধ্যা ৬ টা এক মিনিটে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ দেশাত্ববোধক গানের মাধ্যমে একে অপরকে বিজয়ফুল পরানোর মধ্য দিয়ে, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে স্যালুট দেওয়ার মাধ্যমে বিজয়ফুল কর্মসূচীর শুভ উদ্বোধন হয়েছে।
‘ডিসেম্বর মাস, বাংলাদেশের বিজয়ের মাস। বিশ্বের যেখানেই থাকুন বিজয়ের মাসে প্রতিদিন বিজয়ফুল পরুন, বিজয়ের গৌরবে সমুন্নত থাকুন এবং ‘৭১ এর শহীদদের স্মরণ করুন আর বাংলাদেশের বিজয়কে বুকে ধারণ করুন’ শ্লোগান এর মাধ্যমে ডিসেম্বর মাসের ১ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত বিশ্বের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের গল্পবলা এবং প্রতিদিন বিজয়ফুল পরার আহবান জানিয়ে প্রতি বছরের মত এবারও শুরু হয়েছে বিজয়ফুল কার্যক্রম।
বিজয়ফুল এর সমন্বয়ক কবি মিলটন রহমান এর সঞ্চালনায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌস সুলতান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, বিজয়ফুলের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি শামীম আজাদ, সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশা, কবি স্টিফেন ওয়াটস, কবি মাইক রাগেট প্রমুখ। কন্ঠ শিল্পী শম্পা কুণ্ড ও ডাঃ জয়িতা দাস গুপ্তা’র নেতৃত্বে সমবেত কন্ঠে দেশাত্ববোধক গান এবং জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ পরিবেশিত হয়েছে।
সভায় বক্তারা বলেন, ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের লুপ্ত চেতনা পুনরুদ্ধার করার জন্য এবং চিন্তা-চেতনার অবক্ষয় দূর করার জন্য বিজয়ফুল কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিয়ত অপমানিত ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন বলে উল্লেখ করে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা তার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
বক্তারা আরো উল্লেখ করেন, নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বার্তা পৌঁছে দিব এটাই আমাদের অঙ্গীকার। তারা বলেন, বছরব্যাপী দেশ -বিদেশে সর্বস্তরের মানুষকে, বিশেষ করে নব প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করে এই কর্মসূচি পালন করা প্রয়োজন ।
বিজয়ফুল প্রথম যখন প্রবর্তিত হয় কর্মসূচী হিসেবে, তখন তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জনানো, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি সম্মান প্রদৰ্শন এবং সেই সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা, বাংলাদেশের যে গৌরবময় ঐতিহ্য সেটাকে তুলে ধরা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, স্মৃতি আজাদ, সেলিনা শেলী, রীনা দাস, সৈয়দা কলি পাশা, কবি কাবেরী মুখার্জি, কবি উদয় শংকর দূর্জয় প্রমুখ।
উল্লেখ্য, প্রবাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসকে তুলে ধরার জন্য বিজয়ফুল কর্মসূচি গত ১৮ বছর যাবৎ পালিত হয়ে আসছে। কবি শামীম আজাদ বিলেত থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি ও ক্যম্পেইন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিজয়ফুল এর সৃষ্টি। বহির্বিশ্বে বসবাসরত বাংলাদেশীদের কাছে বিজয়ফুল হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক।
বিজয়ফুল তৈরীর সময়ে একটি ক্রিয়েটিভ কর্মকান্ডের মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার সুযোগটা পাওয়া যায়। বিজয়ফুল একটা উপলক্ষ্য।
বাচ্চারা বিজয়ফুল তৈরী করার সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা পাশে বসে মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ জয়ের গল্প শোনান। এতে নতুন প্রজন্মের কাছে একাত্তরের বার্তা পৌঁছে যায়। ছেলেমেয়েরা যখন নিজ হাতে পাঁচটি সবুজ পাপড়ি ও একটি লাল গোলকের সম্মিলনে ফুল তৈরী করে, তখন তাদের শেখানো হয় মাঝখানের বৃত্ত আমাদের বিজয়ের লাল সূর্য, আর পাঁচটি পাঁপড়ির মাধ্যমে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা-নানা ধর্মের মানুষের সহমর্মিতা, আমাদের মৌলিক অধিকার ইত্যাদি। তাই বিজয়ফুল বানানোর সময় নতুন প্রজন্মের সামনে গোটা বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে। বিজয়ফুল শুধু লন্ডনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি ডিসেম্বরে বহুজন বুকে বিজয়ফুল পরেন, হৃদয়ে বিজয়ের চেতনা ধারণ করেন।
বিজয় ফুল এর আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছা দূত হলেন ডঃ সেলিম জাহান এবং বিজয়ফুল এর লন্ডন অপর দুজন শুভেচ্ছা দূত হলেন গৌরী চৌধুরী এবং ঊর্মি মাযহার।
আরও পড়ুন ⤵
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে কবি শামীম আজাদ ও তাঁর বন্ধু-পরিচিতদের মধ্যে বিজয়ফুলের ধারণা দানা বাঁধতে থাকে। তাঁরা নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের বিজয়বার্তা পৌঁছানোর তাগিদ অনুভব করেন। শামীম আজাদ শিশুদের সঙ্গে কাজ করেন। তাদের গল্প শোনান, শিশুদের গল্পও শোনেন। সার্থকতার সঙ্গে শামীম আজাদ এবং বিজয়ফুল টীম এ কাজ সুষ্ঠু ভাবে করে চলেছেন। একটা আনন্দময় কাজের অছিলায় নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট আর ইতিহাস গল্পের ছলে তুলে ধরতে পারলে তারা বিষয়টিতে মজা পায়।
বিলেতের শিশুরা নভেম্বর মাসে সবার বুকে পপি ফুল দেখে অভ্যস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি নিজেদের গৌরবগাঁথা স্মরণ করে কাগজের বা কাপড়ের তৈরি লাল পপি দিয়ে। শিশুদের অভ্যস্ততাকে কাজে লাগিয়ে একটা ফুল দিয়ে বিজয় দিবস উদ্যাপন ও বিজয় দিবসের পাঠ দিতে পারে শিশুদের। তবে ফুলটা হতে হবে সহজে আঁকা যায়—এমন, আবার রংটা যেন আমাদের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের সঙ্গে মিলে যায়। এসব চিন্তা থেকে শেষ পর্যন্ত জন্ম নেয় বিজয়ফুলের ঐতিহ্য। এই ফুল কোনো গাছে ধরে না, এই ফুল ফোটে হৃদয়ের মাঝে।
কয়েক বছরের মধ্যেই যুক্তরাজ্য ছেড়ে এ কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কর্মসূচি পালিত হয়। যুক্তরাজ্যের বাইরেও বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষীরা এ কর্মসূচি পালন করে আসছে। এসব দেশে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিশু-কিশোররা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিজয়ফুল তৈরি ও বিতরণে কাজ করছে। ‘পাঁচটি পাপড়ি দিয়ে কত কিছু বোঝানো যায়! পাঁচটি মৌলিক অধিকার, আমাদের সমাজের পাঁচটি গোষ্ঠী—মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। বিজয়ফুলের মাঝখানের লাল বৃত্তটি আমাদের স্বাধীনতার সূর্যের প্রতীক।’
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, অক্সফোর্ড, এলএসই ও ইউসিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংঠন ও গবেষণা বিভাগ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণায় ‘বিজয়ফুল’ কথা উল্লেখ করেছেন এবং বিজয়ফুল এর উদ্যোক্তা কবি শামীম আজাদ এর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন।
বিজয়ফুল এর ওয়েবসাইট www.bijoyphool.co.uk এবং The university of Oxford/UCL ‘Portrait EMB research project – www.portraitemb.co.uk তে এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।



