মামদানির ম্যাজিকে হোয়াইট হাউস জয়
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ২:০২:৩৮ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ‘এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন’ মামদানি। “ভেনি, ভিডি, ভিসি” (Veni, vidi, vici) উক্তিটি করেছিলেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। এই ল্যাটিন শব্দগুচ্ছের অর্থ হলো “এলাম, দেখলাম, জয় করলাম”। জুলিয়াস সিজার তার একটি সামরিক বিজয়ের পর রোমের সিনেটকে এই উক্তির মাধ্যমে দ্রুত জয়লাভের খবর জানিয়েছিলেন।
মামদানির হোয়াইট হাউস সফর ছিল এমনই। অনেকের আশঙ্কা ছিল—ইউক্রেনের নেতা ভলোদিমির জেলেনস্কির ভাগ্য হয়ত বরণ করতে হতে পারে জোহরান মামদানিকে। কারো মনে উঁকি দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি সিরিল রামাফোসার স্মৃতি। হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বিরোধীদের কিভাবে ‘হোয়াইট ওয়াশ’ করেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই দুই রাষ্ট্রনায়ক।
কিন্তু, জোহরান মামদানিকে দেখা গেল বিজয়ীর বেশে। তিনি জয় করলেন হোয়াইট হাউস। জয় করলেন ‘ফ্যাসিস্ট’ ট্রাম্পের মনও। তাই এক সাংবাদিক যখন জোহরান মামদানিকে প্রশ্ন করলেন, তিনি ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট বলেছিলেন, এখনো তা বিশ্বাস করেন কিনা। জোহরানকে জবাব দিতে হয়নি। দিয়েছেন খোদ রাষ্ট্রপতি। কথার মাঝেই জোহরান মামদানির বাহুতে চাপড় দিয়ে বলেন, ‘বলে দাও, হ্যাঁ। এত ব্যাখ্যা করার থেকে সোজা ‘হ্যাঁ’ বললেই ঝামেলা চুকে যায়।’ ওই কয়েক সেকেন্ডের ক্লিপটা ভাইরাল হয়ে গেছে।
শুধু মুখে বলা নয়, যেভাবে জোহরানের বাহুতে চাপ ও চাপড় দিয়ে আশ্বস্ত করে ট্রাম্প কথাগুলো বললেন তা ইতিহাস হয়ে গেল। হাজারো কথার ভিড়ে সেই দুইটি বাক্যই হয়ে গেল ‘চুম্বক অংশ’। হাজারো দৃশ্যপটের ভিড়ে সেই ‘স্নেহভাব’ হয়ে গেল মূল আকর্ষণ। আর উপস্থিত সাংবাদিকদের হাসি সেই ঘটনাকে করে দিল ঐতিহাসিক।
‘জোহরান জাদু’
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে, বিশেষ করে মার্কিন গণমাধ্যম ট্রাম্প-জোহরান বৈঠক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘মামদানি ম্যাজিক’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করছেন। কোনো কোনো আলোচক বলছেন যে ‘জোহরান জাদু’তে মজেছেন ট্রাম্প।
গত ২১ নভেম্বর হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে জোহরানের সংবাদ সম্মেলন যারা পুরোটুকু দেখেছেন তারা জানেন যে, ট্রাম্পের চোখে ‘কমিউনিস্ট’ মেয়র জোহরান নিউইয়র্কবাসীদের আবাসন সংকট দূর করার কথা যখনই বলেছেন আবাসন ব্যবসায়ী ট্রাম্প তখনই তা হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন। ট্রাম্প জানেন, যত বেশি নতুন ভবন তৈরি হবে আবাসন ব্যবসা তত বড় হবে। আবাসন সংকট কিছুটা হলেও কমবে। সাংবাদিকদের সামনে এসব কথা বলতে দ্বিধা করেননি ট্রাম্প।
অন্যদিকে, জোহরান দেখেছেন ফ্যাসিস্ট ট্রাম্পও শান্তি চান; ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই। ট্রাম্প চান নিউইয়র্কের সার্বিক উন্নতি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল শহর নিউইয়র্ক আরও উন্নত হোক—একই চাওয়া দুই নেতার।
মাত্র মাস খানেক আগেও যারা একে অপরকে শত্রু হিসেবে গালি দিতেন, একে অপরের দিকে ‘ঘুষি’ ছুড়ে দিতেন, তারাই ওভাল অফিসে করমর্দন করলেন। সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প প্রকাশ্যেই বললেন, তিনি জোহরান মামদানিকে সহযোগিতা করতে চান। তাকে আঘাত করতে চান না। আরও জানালেন, জোহরান মামদানি সফল হলে তিনি সবচেয়ে খুশি হবেন।
শুধু তাই নয়, পুরো সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পকে দেখা গেল জোহরানের তোষামোদি করতে। আবার জোহরানকেও দেখা গেল ট্রাম্পের তোষামোদিকে পাত্তা না দিতে। প্রায় ৩০ মিনিটের সেই সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই ট্রাম্প বলে বসলেন, ‘আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।’
সেই ফলপ্রসূ আলোচনা ছিল—নিউইয়র্কবাসীর অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসাকে সুলভ করতে কী কী করা যেতে পারে তা নিয়ে। নিউইয়র্কবাসীর নিরাপত্তা, বিনা ঝক্কিতে চলাচল ও অপরাধ কমানোর প্রসঙ্গেও তারা আলোচনা করেছেন বলে জানালেন। ট্রাম্প বহুবার বললেন, জোহরান মহান নেতা। তিনি আশা করছেন যে জোহরান সফল হবেন। ট্রাম্পের ভাষাতেই বোঝা গেল— তার একসময়ের ‘দুঃস্বপ্ন’ জোহরান পরিণত হয়েছেন ‘সুখস্বপ্নে’।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প জানালেন, অনেক বিষয়ে তাদের দ্বিমত থাকলেও অনেক বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন। যে ট্রাম্প মার্কিনিদের সুলভে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করার কথা বলে জনগণের প্রচুর ভোটে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন সেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে জোহরানও মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। দুইজন দুটি ভিন্ন দলের হলেও তারা চান জনগণের মঙ্গল।
আরও পড়ুন ⤵
এই দুই নেতাই চান বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বন্ধ হোক। জনগণের করের টাকা যুদ্ধক্ষেত্রে খরচ না করে তা নিজ দেশের জনগণের সার্বিক উন্নয়নে খরচ করা হোক। তাই ট্রাম্প রসিকতা করে জোহরানকে বললেন, ‘আমার সমর্থকরাও দলে দলে তোমাকেই ভোট দিয়েছে।’ কেননা, জোহরান জানালেন, ট্রাম্পের ইস্যুগুলো নিয়েই তিনি ভোটারের কাছে গিয়েছিলেন। আর ট্রাম্প জানালেন, এই দুই প্রার্থীর নির্বাচনী ইশতেহার একই ছিল।
শুধু তাই নয়, ইসরায়েল প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে জোহরান মামদানি নিঃসংকোচে ট্রাম্পের সামনেই বললেন, ‘ইসরায়েল সরকার গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে। মার্কিন সরকার সেই গণহত্যা চালাতে সহযোগিতা করেছে।’ ট্রাম্প এই কথার বিরোধিতা করেননি। তবে ট্রাম্প বারবার বললেন, ‘আমরা দুইজনই শান্তি চাই’।
পুরো সংবাদ সম্মেলনে মহাক্ষমতাধর ট্রাম্পকেই ‘নতজানু’ দেখা গেল। বললেন, জোহরান তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। অথচ মাস খানেক আগেই তিনি বলেছিলেন, জোহরান নির্বাচিত হলে নিউইয়র্কের ফেডারেল ফান্ড বন্ধ করে দেবেন।
জোহরানেরই জয়
গত ২০ নভেম্বর নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাওয়া আগে জোহরান মামদানি নিউইয়র্কের মেয়র কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, তার লোকজন হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন। জোহরান জানালেন, তিনি আগামী ১ জানুয়ারি মেয়র হিসেবে শপথ নেবেন। তবে এর আগেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে তিনি নিউইয়র্ক-কেন্দ্রিক সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলতে চান।
যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতির পদ সামলানোর পরই নিউইয়র্কের মেয়রের পদ সামলানো সবচেয়ে কঠিন কাজ—সে কথাও জানালেন জোহরান। তাই শপথ নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাননি তিনি। আগেভাগেই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া সেরে নিতে চান তিনি। আরও চান তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও নিউইয়র্কবাসীর আশা-প্রত্যাশা সম্পর্কে ট্রাম্পকে অবহিত করতে।
আরও পড়ুন ⤵
ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে নিউইয়র্কবাসীকে জোহরান মামদানি জানালেন, তিনি রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পকে কী বিষয়ে কথা বলতে চান। সেখানে গিয়ে তিনি তা জানালেনও। অর্থাৎ, জোহরান তার কথা রেখেছেন। ট্রাম্পকে যেসব কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তিনি তাকে বলতে পেরেছেন। দুই নেতার কথা শুনে মনে হলো জোহরান কোনো সংকোচ ছাড়াই সেগুলো বলতে পেরেছেন। তাই ট্রাম্প নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়রকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ও বেশ স্মার্ট। ও বেশ যৌক্তিক’।
ওয়াশিংটনে যাওয়ার প্লেনে চড়ে জোহরান যখন সেলফি দিলেন তখনও কেউ ভাবতে পারেননি যে এই জননেতা ওয়াশিংটন থেকে বিজয়ীর বেশে নিজ শহরে ফিরবেন। কিন্তু, সব আশঙ্কা উবে গেল তখনই যখন ট্রাম্প নিজের মুখে জোর দিয়ে একাধিকবার বললেন, ‘আলোচনা ফলপ্রসূ’ হয়েছে। তার এই বাক্যেই ফুটে উঠে—জোহরান মামদানির হোয়াইট হাউস জয়।




