গ্রহাণু বিপর্যয়ে ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন, মহাবিপর্যয় থেকে জীবনের নতুন রূপ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ৯:৪৯:৩৬ অপরাহ্ন
অনুপম প্রতিবেদক: প্রায় ছেষট্টি মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটে। ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড অনুসারে, এই সময়েই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় এক বিশাল প্রাণীগোষ্ঠী—ডাইনোসর। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক চলেছে, কীভাবে এই প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীগোষ্ঠী হঠাৎ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল। আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে এখন যে ব্যাখ্যা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত, তা হলো—একটি বিশাল গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল, এবং সেই বিপর্যয়ই ডাইনোসরদের যুগের সমাপ্তি ঘটায়।
বর্তমান মেক্সিকোর ইউকাতান উপদ্বীপে আবিষ্কৃত চিক্সুলুব ক্রেটার (Chicxulub Crater) এই তত্ত্বের প্রধান প্রমাণ। প্রায় ১০ কিলোমিটার ব্যাসের একটি গ্রহাণু এখানে আঘাত হানে, যার ফলে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার প্রশস্ত গহ্বর সৃষ্টি হয়। আঘাতের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লক্ষ লক্ষ কোটি টন ধূলিকণা, বাষ্প ও শিলাস্তর বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধূলিকণার স্তর সূর্যালোককে বাধা দেয়, ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত কমে যায়। সূর্যালোকের অভাবে গাছপালা মারা যেতে শুরু করে, আর সেই সঙ্গে ভেঙে পড়ে খাদ্যশৃঙ্খল।
তৃণভোজী প্রাণীরা প্রথমে খাদ্য সংকটে মারা যায়, এরপর মাংসাশী প্রাণীরাও টিকে থাকতে পারেনি। কয়েক বছরের মধ্যেই ডাইনোসর প্রজাতির প্রায় সব ধরনের অস্তিত্ব মুছে যায়। ভূতাত্ত্বিক স্তরে পাওয়া ইরিডিয়াম ধাতুর স্তর এই গ্রহাণু তত্ত্বকে আরও শক্ত প্রমাণ দেয়, কারণ পৃথিবীতে এই ধাতু বিরল হলেও গ্রহাণুতে এটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
তবে বিজ্ঞানীরা একে একমাত্র কারণ বলে থেমে থাকেননি। একই সময় ভারতের ডেকান ট্র্যাপস অঞ্চলে বিশাল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। এসব অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে, যা দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর তাপমাত্রা কখনো অতিরিক্ত বেড়ে, কখনো হঠাৎ কমে গিয়ে জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়ানক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে।
এ ছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন ও মহাদেশীয় সঞ্চালন প্রক্রিয়াও তখনকার জীবজগতের আবাসস্থলে বড় প্রভাব ফেলে। অনেক অঞ্চল শুষ্ক হয়ে পড়ে, অনেক বনভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সব মিলিয়ে গ্রহাণু আঘাতের ধাক্কা এবং পরিবেশগত এই পরিবর্তনগুলো একত্রে পৃথিবীর তৎকালীন জীবনের ওপর চূড়ান্ত বিপর্যয় বয়ে আনে।
ফসিল রেকর্ডে দেখা যায়, এই ঘটনাটির পর হঠাৎ করে ডাইনোসরদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু একই সঙ্গে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উত্থান শুরু হয়। অর্থাৎ, এক বিপর্যয় এক যুগের অবসান ঘটালেও, সেটিই আরেক নতুন যুগের সূচনা করে।
সবশেষে বলা যায়, ডাইনোসরদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকলেও গ্রহাণু বিপর্যয়ই ছিল প্রধান ও প্রত্যক্ষ কারণ, আর আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ ও জলবায়ু পরিবর্তন তার পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিল। এই ঘটনাই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের ইতিহাসে এক বিশাল মোড় ঘুরিয়ে দেয়, যার ফলেই পরবর্তীতে মানুষের বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়।
মহাবিপর্যয় থেকে জীবনের নতুন রূপ
গ্রহাণু আঘাত ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক মহাবিপর্যয়। কিন্তু সেই বিপর্যয়ের ভেতর দিয়েই জীবনের নতুন রূপ বিকাশ লাভ করে। ডাইনোসরদের বিলুপ্তি আমাদের শেখায়—প্রকৃতি কখনো থেমে থাকে না; এক প্রজাতির পতনের মধ্য দিয়েই আরেক প্রজাতির উদ্ভব ঘটে।
শুধু ডাইনোসর যুগেই নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে এমন পরিবর্তন। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক উদাহরণ দেওয়া হল, যেখানে বড় বিপর্যয়ের পর নতুন প্রাণ, নতুন পরিবেশ বা নতুন জীববৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে।
ডাইনোসরদের বিলুপ্তি, স্তন্যপায়ীদের উত্থান
প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে গ্রহাণু বিপর্যয়ে ডাইনোসর বিলুপ্ত হলেও, তার ফলেই পৃথিবীতে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (mammals) বিকাশ শুরু হয়। ডাইনোসরের অবর্তমানে বন-জঙ্গল ও খাদ্যশৃঙ্খল নতুনভাবে গড়ে ওঠে, আর সেই ধারাতেই মানুষ পর্যন্ত বিবর্তিত হয়।
আগ্নেয়গিরি বিপর্যয়, নতুন দ্বীপ ও ইকোসিস্টেম
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে যখন পুরনো অঞ্চল ধ্বংস হয়, তখন গলিত লাভা থেকে নতুন ভূমি তৈরি হয়।
উদাহরণস্বরূপ—আইসল্যান্ড ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। সেখানকার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতই নতুন দ্বীপ সৃষ্টি করেছে, পরে সেখানে ধীরে ধীরে উদ্ভিদ ও প্রাণের আবাস গড়ে উঠেছে।
প্রাচীন সমুদ্র বিপর্যয়, স্থলজ প্রাণের বিকাশ
প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন বছর আগে সমুদ্রের প্রাণীদের বিশাল অংশ বিলুপ্ত হয়েছিল (Ordovician extinction)। কিন্তু সেই বিপর্যয়ের পরেই কিছু প্রাণ স্থলে অভিযোজিত হয়। ফলস্বরূপ, স্থলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর সূচনা ঘটে।
বরফযুগ, নতুন প্রজাতির অভিযোজন
বরফযুগে (Ice Age) প্রচুর প্রজাতি বিলুপ্ত হয়, কিন্তু একই সঙ্গে কিছু প্রাণী ঠান্ডা পরিবেশে অভিযোজিত হয়—যেমন ম্যামথ, স্নো লেপার্ড, ও পরবর্তীকালে আধুনিক মানুষ। এই অভিযোজনই ছিল জীববিজ্ঞানের বিবর্তনের এক বড় পদক্ষেপ।
বন ধ্বংস, নতুন বাস্তুতন্ত্রের উদ্ভব
বড় বনভূমি পুড়ে গেলে বা ঝড়-বন্যায় ধ্বংস হলে প্রথমে তা প্রাণহীন মনে হয়। কিন্তু কিছুদিন পর সেই মৃত মাটিতে নতুন প্রজাতির ঘাস, গাছ ও কীটপতঙ্গ জন্ম নিতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ecological succession — পুরনো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের সৃষ্টি।
অক্সিজেন বিপ্লব (Great Oxygenation Event)
প্রায় ২৪০ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবীর প্রাথমিক জীব ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেন উৎপন্ন করতে শুরু করে, তখন অনেক পুরনো জীব প্রজাতি সেই অক্সিজেনে মারা যায়। কিন্তু সেই “বিপর্যয়”-এর ফলেই পরবর্তীতে জটিল প্রাণের উদ্ভব হয়।
মহামারির পর পরিবর্তন
আধুনিক উদাহরণ হিসেবে—ব্ল্যাক ডেথ (১৪শ শতক) বা কোভিড-১৯—উভয় ক্ষেত্রেই বিপুল প্রাণহানি ঘটলেও, পরবর্তীতে মানুষ নতুন সামাজিক কাঠামো, চিকিৎসা-পদ্ধতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পথে হাঁটতে শিখেছে।




