‘মন মাঝি খবরদার’—গানটি আসলে কার? (ভিডিও)
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:০৬:০১ অপরাহ্ন
অনুপম সাহিত্য ডেস্ক: কিছুদিন ধরে ফেসবুক ও ইউটিউবে একটি গান নিয়ে ব্যাপক চর্চা হচ্ছে—‘মন মাঝি খবরদার’। তরুণ শিল্পীরা বিভিন্ন আড্ডায় গানটি গাইছে, সে ভিডিও হচ্ছে ভাইরাল। অথচ কোথাও উল্লেখ নেই, গানটি আসলে কার।
‘মন মাঝি খবরদার, আমার তরী যেন ভেড়ে না, আমার নৌকা যেন ডোবে না’—সহজ কথা, সরল সুর।
তবু ভেতরে রয়েছে মাটির টান, যে টানের কাছে ধরা দেয় বাঙালি মন, যুগ যুগ ধরেই। এর ফলে সম্প্রতি হঠাৎ করেই সামাজিক মাধ্যম কিংবা ইউটিউব, সবখানে গানটি ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেসব কাভার ভার্সন শুনে মুগ্ধতাও খুঁজে পাচ্ছেন শ্রোতারা। অন্তর্জালে ভিউ দেখলেও তাজ্জব বনে যেতে হয়! তরুণদের গানের দল ‘ভাবের তরী’।
বিভিন্ন গান কাভার করে তারা। মাসখানেক আগে ‘মন মাঝি খবরদার’ গেয়ে আপলোড করেন। মোহাম্মদ আলামিনের গায়কীতে মজে যায় মানুষ।
শুধু তাদের চ্যানেলেই গানটির ভিউ ছাড়িয়েছে এক কোটি ১০ লাখ।
এ ছাড়া তাদের ফেসবুক পেজে গানটির ভিউ হয়েছে ৯৫ লাখ। হাজার হাজার মানুষ গানটি শেয়ার করছে, জানাচ্ছে ভালোলাগার কথা। ১৫ আগস্ট একইভাবে গানটি কাভার করেছেন পারভেজ খান। শুধু তাঁর ফেসবুক পেজে ছয় দিনে গানটির ভিউ ছাড়িয়েছে দেড় কোটি। এ ছাড়া তাঁর কাভার ভার্সনটি আরো অনেক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে ছড়িয়ে গেছে, সেগুলোতেও হচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ।
অতীতেও বিভিন্ন সময়ে এ গান করেছে অনেকে। ৯ বছর আগে ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’ গানটিকে ‘ইসলামী গান’ হিসেবে প্রচার করে। যদিও প্রায় দুই দশক আগে গানটি গেয়েছিলেন জাহিদ পিন্টু। তাঁর কণ্ঠেই মূলত এ গান সামনে আসে। এ কারণে কিছু জায়গায় গানটির কথা ও সুর তাঁর বলে দাবি করা হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এ শিল্পী আড়ালে, সংগীতাঙ্গনের অনেকের মাধ্যমে তাঁর খোঁজ করার চেষ্টা করা হলেও মেলেনি সন্ধান। জাহিদ পিন্টুর কণ্ঠে গানটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রেম শিকারী’ অ্যালবামে। যেটার সংগীত পরিচালনা করেছিলেন বালাম। কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
বালাম জানালেন, ২০০৫ কিংবা ২০০৬ সালের দিকে এ অ্যালবাম বাজারে এসেছিল। এতে মোট ৯টি গান রয়েছে। যার মধ্যে চারটি অরিজিনাল বা মৌলিক। বালাম বলেন, “যতদূর মনে পড়ে, এটা সংগৃহীত গান হিসেবে অ্যালবামে রাখা হয়েছিল। অ্যালবামে আমি এবং আমার বোন জুলি যে চারটি গান গেয়েছি, সেগুলো অরিজিনাল; বাকিগুলো বিভিন্ন শিল্পীর বা সংগৃহীত। যেমন অভি গেয়েছিল ‘দয়াল’ গানটি, যেটা পরাণ ফকিরের লেখা। আবার লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানটিও আছে। তো এ গানটি যদি জাহিদ পিন্টুর লেখা হতো, সে নিশ্চয়ই আমাকে বলত।”
ইন্টারনেটেও গানটি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ২০১৮ সালে ‘মরুভূমি’ ব্যান্ড গানটি কাভার করেছিল। সে সময় তার গানটিকে মুনতাজ ফকিরের বলে উল্লেখ করে। তবে সেটার পক্ষেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অবশেষে লিখিত তথ্য পাওয়া গেল ফোকলোর গবেষণায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষক ড. তপন বাগচীর কাছে। তিনি নিশ্চিত করলেন, এটি তাঁর অঞ্চল অর্থাৎ ফরিদপুরের প্রচলিত গান। নথি অনুসারে গানটি চরভদ্রাসন উপজেলার দীনু ফকিরের।
তপন বাগচী বলেন, “গানটি কবি জসীমউদ্দীনের ‘মুর্শিদা গান’ সংকলনে রয়েছে। কবি নিজেই এতে লিখেছেন, ১৯২৪ সালে চরভদ্রাসনের দীনু ফকিরের কাছ থেকে গানটি সংগ্রহ করেছেন তিনি। এটি মুর্শিদাগানের ধারায় নৌকার গান হিসেবে চিহ্নিত, যাকে সারিগান বলা যায়। এটি বিভিন্ন শিল্পী গেয়েছেন, কিন্তু গীতিকবি ও সংগ্রাহকের নাম উল্লেখ না করে, যা সমর্থনযোগ্য নয়। আশা করি এবার তারা প্রকৃত স্রষ্টার নাম উল্লেখ করবেন।”
বাগচীর কাছ থেকে পাওয়া গেল গানের পুরনো সংস্করণটিও। যেখানে গানটির কথা এ রকম, ‘আমার নৌকা যেন ডোবে না, আমার তরী যেন ডোবে না/ মন মাঝি খবরদার/ সাড়ে তিন হাত নৌকা খানিরে, ঘন ঘন গুরা/ এই নৌকা খান বাইতে আমারে, হাড্ডি হৈল গুঁড়ারে/ মাস্তুলে উঠিয়া মাঝিরে, বলছে হায় হায়/ পিছের দিকে চায়া দেখরে, বেলা ডুইবা যায় রে/’। বর্তমানে যারা গানটি গাইছেন, তাদের কথার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন রয়েছে। সঠিক তথ্য না জানার কারণে সময়ের পালাবদলে এমনটা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।




