রাশিয়া—যুক্তরাষ্ট্র: পারমাণবিক হামলার হুমকির প্রেক্ষাপটে ৮ আগস্ট নিষেধাজ্ঞা দেবেন কি ট্রাম্প?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ৪:০৪:৩৫ অপরাহ্ন
সারওয়ার চৌধুরী: বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে রাশিয়া (প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বরাবরই দ্বন্দ্বে মোড়ানো। স্নায়ুযুদ্ধের যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যন্ত এই দুই পরাশক্তি বৈশ্বিক রাজনীতির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ, ন্যাটোর সম্প্রসারণ, সামরিক মহড়া এবং পারস্পরিক হুমকি—সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে: রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র কি আবারো সরাসরি পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কায় পড়েছে?
স্নায়ুযুদ্ধের ছায়া আবারও ঘনাচ্ছে?
১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পর বিশ্ব নতুন এক ধ্বংসাত্মক যুগে প্রবেশ করে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন এবং ১৯৬২ সালের কিউবান মিসাইল সংকট বিশ্ববাসীকে সরাসরি পারমাণবিক যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করায়। যদিও শেষ পর্যন্ত তা এড়ানো সম্ভব হয়, তবে ওই সময় থেকেই রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ‘মিউচুয়াল অ্যাসিউরড ডেস্ট্রাকশন’ বা ‘পারস্পরিক নিশ্চয় ধ্বংস’-এর কৌশলের মধ্যে দিয়ে একে অপরকে ঠেকিয়ে রেখেছে।
বর্তমানে সেই ছায়া আবার ফিরে এসেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বেশ কয়েকবার পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বও সরাসরি না জড়ালেও ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক উত্তেজনার মূল কারণ
২০২৪-২৫ সময়কালে ইউক্রেন যুদ্ধ আরও জটিল হয়ে উঠেছে। রাশিয়া ডনবাস, লুহানস্ক, খেরসন অঞ্চলে অবস্থান দৃঢ় করেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি দিয়ে সামরিকভাবে শক্তিশালী করছে। এমনকি কিছু ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র রুশ ভূখণ্ডে হামলা চালানোর অনুমতি ইউক্রেনকে দিয়েছে—যা সরাসরি উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
সম্প্রতি রাশিয়া বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র পোল্যান্ড ও রোমানিয়াতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বিশ্লেষক সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে যে, রাশিয়া হয়তো সীমিত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে “টার্গেটেড ডেমোনস্ট্রেশন” চালাতে পারে, যদি ইউক্রেনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে।
এই অবস্থায়, দু’পক্ষের মধ্যেই চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ না হলেও উভয়ের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের ফাটল আরও গভীর হয়েছে।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বাস্তবতা কতটা?
পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার সহজ সিদ্ধান্ত নয়। কারণ, একবার ব্যবহৃত হলে পাল্টা আঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। বর্তমানে রাশিয়ার কাছে আনুমানিক ৬,০০০টির বেশি পরমাণু ওয়ারহেড রয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রয়েছে প্রায় ৫,৫০০টি। এই অস্ত্রগুলো শুধু সামরিক স্থাপনায় নয়, গোটা শহর ধ্বংসে সক্ষম।
বিশ্বজুড়ে ‘পারমাণবিক নীতিমালা’ হলো: প্রথমে কেউ ব্যবহার করবে না (No First Use)। তবে রাশিয়া তাদের সামরিক নীতিতে লিখিতভাবে বলেছে—“রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে।”
ইউক্রেন যুদ্ধে যদি রাশিয়ার ভিত নড়ে, বিশেষ করে যদি ক্রাইমিয়া হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে পুতিন রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে এমন একটি অস্ত্র প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন—এমন আশঙ্কা এখন আর একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্র এখনও সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে যায়নি, কিন্তু সামরিক সহায়তা এবং কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে রাশিয়াকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্ট করে বলেছেন, “আমরা ইউক্রেনের পক্ষে থাকব যতদিন প্রয়োজন হবে।” এটি রাশিয়ার কাছে হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ এশিয়া অঞ্চলে কৌশলগত মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে—যা রাশিয়া-চীন জোটকেও উদ্বিগ্ন করছে। সুতরাং, বর্তমান উত্তেজনা শুধু ইউক্রেন কেন্দ্রিক নয়—বরং একটি নতুন বৈশ্বিক শক্তি ভারসাম্যের চিত্র উঠে আসছে।
চীন ও অন্যান্য দেশের অবস্থান
রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার মধ্যে চীন একটি কৌশলগত ‘নীরব শক্তি’। যদিও চীন প্রকাশ্যে পরমাণু যুদ্ধের বিরুদ্ধে, তবে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার জালে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দিচ্ছে। চীন নিজেও একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ, এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত।
অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ভারত, পাকিস্তান—এই পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলোর আচরণও এখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। কারণ, বড় দুই শক্তির মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়াও ব্যাপক হতে পারে।
সাধারণ মানুষের চোখে
সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় ভয় হলো—‘যদি হঠাৎ যুদ্ধ লেগে যায়?’ এখনকার যুদ্ধ আর আগের মতো সীমাবদ্ধ থাকবে না। পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের ফলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতি, জলবায়ু এবং মানবসভ্যতার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। ‘নিউক্লিয়ার উইন্টার’ বা পারমাণবিক শীতলতা নামক ধারণা বলছে—একটি সীমিত পরমাণু যুদ্ধেও খাদ্য সংকট, আবহাওয়ার বৈরিতা এবং লক্ষ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এখনো সরাসরি পারমাণবিক যুদ্ধে জড়ায়নি, এবং সম্ভাবনাও খুব বেশি নয়। তবে ঝুঁকি একেবারে শূন্য নয়। উভয়ের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট, ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনা, এবং তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা বিশ্বকে এক নতুন অজানা বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যুদ্ধ বন্ধে শিগগিরই একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। নাহলে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী দুই দিন পর অর্থাৎ ৮ আগস্ট রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করবেন ট্রাম্প। এরিমধ্যে পুতিনের সাথে খুব শিগগিরই সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, নিরপেক্ষ শক্তিগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। যুদ্ধ নয়, আলোচনার টেবিল হোক পারমাণবিক শান্তির পথ। কারণ, পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে বিজয় পাওয়া যায় না—পাওয়া যায় শুধু ধ্বংস।




