রক্তে বিপজ্জনক সীসা কেন হয়? প্রতিরোধে যা করতে হবে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ৯:৪৩:৫৪ অপরাহ্ন
অনুপম প্রতিবেদক: বাংলাদেশে শিশুদের রক্তে সীসা (Lead) পাওয়া যাওয়ার বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক। সীসা একটি বিষাক্ত ভারী ধাতু এবং এটি স্নায়বিক ক্ষতির কারণ হতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের জন্যে খুব ক্ষতিকর। উচ্চ সীসার মাত্রা ভিটামিন ডি এবং হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণের পাশাপাশি রক্তাল্পতা , তীব্র কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাধি এবং সম্ভবত মৃত্যু ঘটায়। রক্তে সীসা (Lead) জমা হওয়ার মূল কারণগুলো হলো—
রক্তে সীসা কেন হয়?
সীসা একটি অত্যন্ত বিষাক্ত ভারী ধাতু। খুব অল্প পরিমাণেও এটি মানুষের শরীরের জন্য বিপজ্জনক, বিশেষ করে শিশুদের জন্য।
১. ব্যবহৃত ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াজন (Recycling of used batteries)
বাংলাদেশে পুরোনো গাড়ির ব্যাটারি ভেঙে সীসা বের করা হয় খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
এতে সীসার গুঁড়ো ও ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং আশেপাশের মানুষ সহজেই শ্বাসের সঙ্গে এটি গ্রহণ করে।
২. দূষিত মসলা, বিশেষ করে হলুদ গুঁড়া
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী হলুদকে উজ্জ্বল দেখানোর জন্য সীসাযুক্ত ক্রোমেট মেশায়।
এটি খাওয়ার মাধ্যমে সরাসরি শরীরে সীসা প্রবেশ করে।
৩. কারখানার দূষণ ও শিল্প বর্জ্য
ব্যাটারি কারখানা
রঙ প্রস্তুতকারী কারখানা
ধাতব গলানো (smelting)
এসব জায়গা থেকে সীসা বাতাসে ও মাটিতে ছড়িয়ে শিশুদের শরীরে ঢোকে।
৪. সীসাযুক্ত রং (Lead-based paint)
অনেক পুরোনো বাড়ি, স্কুল, আসবাবপত্রে এখনও সীসাযুক্ত রং থাকে।
রং খসে পড়লে শিশুরা হাত-মুখে নিয়ে সীসা খেয়ে ফেলে বা শ্বাসে নেয়।
৫. সীসাযুক্ত পাইপলাইন বা পানির ট্যাংক
কিছু এলাকায় পুরোনো লোহার/সীসার পাইপ ও ট্যাংকে পানি জমে সীসা পানিতে মিশে যায়।
৬. মাটি ও ধুলাবালিতে সীসা
ব্যস্ত সড়কের পাশে, শিল্পাঞ্চলের কাছে, ব্যাটারি ভাঙার স্থানে মাটিতে সীসা জমে থাকে।
শিশুরা খেলতে গিয়ে হাত-মুখে নিলে বা ধুলো শ্বাসে নিলে সীসা শরীরে যায়।
৭. আমদানিকৃত খেলনা ও সস্তা জিনিসপত্র
কিছু খেলনা, স্কুল ব্যাগ, পেন্সিল বক্স, চায়না মাটি— এসবেও সীসাযুক্ত রং থাকে।
শিশুরা এগুলো মুখে দিলে বা স্পর্শ করলে সীসা শরীরে চলে যায়।
সীসার ক্ষতি কেন বেশি?
বিশেষ করে ৫ বছরের নিচের শিশুদের জন্য এটি ভয়ংকর, কারণ—
মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে, বুদ্ধিমত্তা কমায়, আচরণগত সমস্যা সৃষ্টি করে, রক্তস্বল্পতা হয়, দীর্ঘমেয়াদে কিডনি ও নার্ভের ক্ষতি করে।
সীসা দূষণ প্রতিরোধে পরিবারের করণীয়
১. খাবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
✔ হলুদ গুঁড়া, মরিচ, মসলা নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে কিনুন
অতিরিক্ত উজ্জ্বল হলুদ রঙের হলুদ অনেক সময় সীসাযুক্ত ক্রোমেটে মেশানো থাকে।
গাঢ়, স্বাভাবিক রঙের হলুদকে অগ্রাধিকার দিন।
✔ বাসায় মসলা গুঁড়া করা সবচেয়ে নিরাপদ
যদি সম্ভব হয়, বাজার থেকে কাঁচা হলুদ কিনে বাসায় নিজে গুঁড়া করুন।
২. ঘর পরিষ্কার রাখা — বিশেষ করে ধুলাবালি কমানো
সীসা অনেক সময় ধুলোবালির সাথেই ঘরে আসে।
প্রতিদিন ভেজা কাপড় দিয়ে মেঝে মুছুন
আসবাবপত্র ভেজা কাপড়ে পরিষ্কার করুন
শিশুদের খেলার জায়গা বিশেষভাবে পরিষ্কার রাখুন
রাস্তার পাশে থাকলে জানালা বন্ধ রাখার চেষ্টা করুন
৩. শিশুদের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা
শিশুরা বাইরে থেকে এসে হাত, মুখ, পা ধুয়ে নেবে
ছোট শিশুকে মাটিতে পড়ে থাকা কোনো জিনিস মুখে দিতে দেবেন না
শিশুর হাত-নখ ছোট ও পরিষ্কার রাখতে হবে
৪. পানির নিরাপত্তা
বাড়ির পানির ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার করুন
পুরোনো লোহার/ধাতব পাইপ হলে তা বদলাতে হবে
কলের পানি কয়েক সেকেন্ড চালিয়ে দিয়ে তারপর সংগ্রহ করা ভালো (পুরনো পাইপ থাকলে)
৫. রঙ করানোর সময় সতর্কতা
যদি বাড়ি বা ঘরে রঙ করা হয়—
সীসামুক্ত (lead-free) রং কিনুন
রঙ করার সময় শিশুদের অন্যত্র রাখুন
পুরোনো রং খসে পড়লে তা তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার করুন
রং শুকানো পর্যন্ত ঘর বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন
৬. খেলনা ও স্কুল জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে সতর্কতা
ব্র্যান্ডেড, মানসম্মত কোম্পানির খেলনা কিনুন
খুব উজ্জ্বল রঙের সস্তা চায়না খেলনা/স্কুল ব্যাগ/পেনসিল বক্স এড়িয়ে চলুন
আরও পড়ুন—
♦ দেশের প্রতি ১০ জন শিশুর ৪ জনের রক্তে উদ্বেগজনক মাত্রায় সীসা: জরিপ
খেলনা ছোট শিশুর মুখে দিতে না দেওয়া
৭. ব্যাটারি ও স্ক্র্যাপ এলাকার কাছে না থাকা
ঘরের কাছে ব্যাটারি ভাঙার দোকান বা কারখানা থাকলে শিশুদের সেখানে যেতে দেবেন না
সম্ভব হলে বাসস্থান পরিবর্তন বা দূরত্ব রাখা ভালো
৮. রান্নাঘর ও খাবার পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা
অ্যালুমিনিয়ামের পুরোনো হাঁড়ি-পাতিল, বিশেষ করে কালো হয়ে যাওয়া, বদলে ফেলা ভালো
খাদ্য সংরক্ষণের পাত্র পরিষ্কার, নিরাপদ প্লাস্টিক বা স্টিলের হতে হবে
৯. পুষ্টি গ্রহণ বাড়ানো
ভালো পুষ্টি সীসার ক্ষতি কমায়।
বিশেষ উপকারী খাবার—
দুধ, ডিম
শাকসবজি
কলা
ডাল, মাশকলাই, ছোলা
ভিটামিন সি (লেবু, কমলা, পেয়ারা)
এগুলো শরীরে সীসা শোষণ কমায়।
১০. প্রয়োজন মনে হলে রক্তে সীসা পরীক্ষা
যদি শিশু—
রাস্তার পাশে খেলে
ব্যাটারি এলাকার কাছে থাকে
ঘন ঘন অসুস্থ হয়
আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়
তাহলে রক্তে সীসা পরীক্ষা করা যেতে পারে। রক্তে সীসা পরীক্ষা (Blood Lead Level Test – BLL test) খুব জটিল নয়, এবং বাংলাদেশে মোটামুটি সহজেই করা যায়। বাংলাদেশে এই পরীক্ষার খরচ ১,৫০০ টাকা থেকে ৩,০০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।
তথ্যসূত্র
UNICEF: “Five Actions to End Childhood Lead Poisoning” — ইউনিসেফের গাইডলাইন যেখানে সীসা দূষণ প্রতিরোধে পাঁচটি মূল পদক্ষেপ উল্লেখ আছে।
WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা): “Lead poisoning and health” ফ্যাক্ট শীট — সীসার স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও প্রতিরোধের সাধারণ দৃষ্টিকোণ।
WHO নির্দেশিকা: “WHO guidance to reduce illness due to lead exposure” — সীসার ক্লিনিক্যাল ব্যবস্থাপনা ও সংস্পর্শের উৎস চিহ্নিত করার প্রস্তাবনা।
CDC (Centers for Disease Control and Prevention): “Preventing Childhood Lead Poisoning” — পরিবেশ থেকে সীসা উৎস অপসারণ, পরীক্ষা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক।




