মামদানির বিজয়: ইসলামোফোবিয়ার মিথ ভাঙার নতুন ইতিহাস (ভিডিও)
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৭:৫৩ অপরাহ্ন
অনুপম প্রতিবেদক: নিউইয়র্কের রাজনৈতিক ইতিহাসে জোহরান মামদানির বিজয় নিঃসন্দেহে এক বহুমাত্রিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা। একজন তরুণ মুসলিম, দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত, অভিবাসী পরিবারের সন্তান হিসেবে তাঁর এই উত্থান শুধু কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক জয় নয়—এটি এক সামাজিক চেতনার পুনর্জাগরণ। আমেরিকার রাজনীতিতে যখন ইসলামোফোবিয়া ও অভিবাসীবিরোধী মনোভাব অনেক সময়েই অঘোষিতভাবে প্রভাব ফেলেছে, তখন মামদানির বিজয় যেন এক জোরালো বার্তা—ধর্ম বা বংশপরিচয় নয়, যোগ্যতাই মানুষের আসল পরিচয়।
জোহরান মামদানির শৈশব কেটেছে উগান্ডায়, পরবর্তীতে তাঁর পরিবার পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে। সেই অভিবাসী জীবনের অনিশ্চয়তা, বৈষম্য ও প্রান্তিকতার অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। নিউইয়র্ক সিটির নানা শ্রেণির মানুষের পাশে দাঁড়ানো, ভাড়া ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, আর প্রগতিশীল সমাজের পক্ষে অকপট অবস্থান—এই সবই তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে।
আরও পড়ুন—
♦ নিউইয়র্ক: যে আইডিয়ায় দুর্দান্ত বাজিমাত করলেন মামদানি
তাঁর বিজয় ভাষণটি ছিল এক অর্থে প্রান্তিক ও পরিশ্রমী মানুষের গৌরবগাঁথা। তিনি বলেছিলেন,
“গুদামে বক্স তোলা হাত, ডেলিভারি বাইকের হ্যান্ডেলে ঘাম ঝরানো তালু, রান্নাঘরের আগুনে দগ্ধ আঙুল—এই হাতগুলো কখনও ক্ষমতা পায়নি। কিন্তু আজ, এই হাতগুলোই ভবিষ্যৎ ধরেছে।”
এই একটি লাইন যেন পুরো নির্বাচনের আত্মা। মামদানি শুধু ভোটে জয়ী হননি, তিনি এক চিন্তার জগতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে ছিল দৃঢ় উচ্চারণ—“আজকের নিউইয়র্ক এমন এক শহর হবে, যেখানে সবাই বাস করতে পারবে, সবাই ভালোবাসতে পারবে।”
বিজয়ের মুহূর্তে তিনি একবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামও উল্লেখ করে বলেছিলেন,
“মিস্টার ট্রাম্প, আমি জানি আপনি দেখছেন—আপনার জন্য চারটি শব্দ আছে: ‘আপনার ভলিউম আপ করুন।’”
এটি শুধু রাজনৈতিক খোঁচা নয়, বরং এক প্রতীকী প্রতিবাদ—যে ভয় ও বিভাজনের রাজনীতি বছরের পর বছর ধরে আমেরিকার মাটিতে ইসলামোফোবিয়া জিইয়ে রেখেছিল, তার বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাসের জবাব।
মামদানির এই উত্থান প্রমাণ করেছে, মুসলিম পরিচয় রাজনীতির বাধা নয়, বরং বৈচিত্র্যের শক্তি। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে তিনি কখনো ধর্মকে ঢাল বানাননি, আবার তা লুকিয়েও রাখেননি। বরং তিনি দেখিয়েছেন—বিশ্বাস ও ন্যায়বোধ একসাথে চলতে পারে। তাঁর বিজয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অগণিত অ-মুসলিম নাগরিকও নিজেদের অংশ দেখেছেন, কারণ মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ন্যায্যতা, বাসযোগ্য শহর, এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজের।
নিউইয়র্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নির্বাচন কেবল শহর প্রশাসনের রদবদল নয়, বরং মানসিকতার রূপান্তর। দীর্ঘদিন ধরে যে ধারণা প্রচলিত ছিল—মুসলিম প্রার্থীরা পশ্চিমা জনমানসে গ্রহণযোগ্য নন—সেই মিথ এক আঘাতেই ভেঙে দিয়েছেন মামদানি। নিউইয়র্কের নতুন এই নেতা ইংরেজি ছাড়াও বাংলা আরবি উর্দু-হিন্দি, লুগাণ্ডা স্পেনিশ ভাষায় কথা বলতে পারেন। তরুণ এ নেতার বাগ্মীতা বিস্ময়কর।
আরও পড়ুন—
♦ ইউক্রেনের আরও ভেতরে যাচ্ছে রুশ বাহিনী, প্রায় বাংলাদেশের সমান ভূখণ্ড রাশিয়ার দখলে
তার বিজয় যেন ঘোষণা করে—ইসলামোফোবিয়া কেবল ভয় নয়, এটি এক ভিত্তিহীন কুসংস্কার, যার কোনো স্থান নেই গণতন্ত্রে। তাঁর কথায়, “আমরা প্রমাণ করেছি—আমরা শুধু কণ্ঠ নই, আমরা নাগরিক; আমরা এই শহরের অংশ, এই দেশের ভবিষ্যৎ।”
আজ যখন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও জাতিগত বিভাজন নতুন করে মাথা তুলছে, তখন জোহরান মামদানির বিজয় এক নতুন আশার আলো। তাঁর এই সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষের আসল শক্তি তার নৈতিক সাহসে, এবং সমাজ বদলায় তখনই, যখন মানুষ ভয়কে উপেক্ষা করে সত্যের পথে হাঁটে।
নিউইয়র্কের বাসিন্দা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত লেখক, ফিল্মমেকার ও জনপ্রিয় সোশ্যাল এ্যাক্টিভিস্ট প্রিসিলা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন— ‘‘আজ প্রায় সতের বছর নিউইয়র্কে আছি । এক বছর আগেও আমি জানতাম না জোহরান মানদানীকে—তার নামও শুনিনি। আমার মত নিউইয়র্কের ৯৮% মানুষও হয়তো তাকে চিনতেন না। আর আজ তিনিই নিউইয়র্কের নির্বাচিত মেয়র, যাকে সারা বিশ্ব চিনে । কিভাবে সম্ভব হলো?
বিশ্বাস করুন, স্কুলের পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও—যাদের ভোট নেই—দলবেঁধে কাজ করেছে মানদানীর জন্য। কেন করেছে? পরিবর্তনের আশা ছিল। মানদানী সবাইকে একটা স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন। শুধুই এশিয়ার মানুষ তাকে ভোট দেয়নি; সব ধর্ম, গোত্র, জাতি ও বর্ণের মানুষই ভোট দিয়েছে।

জোহরান মামদানি ও প্রিসিলা
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বহু হুমকি দিয়েছেন, এবং অ্যান্ড্রু কুমো অনেক মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। তবুও জনতার মন বদলায়নি —দুই দল মিলে তাকে হারাতে পারেনি। ট্রাম্প বা কোনো শক্তি সুষ্ঠ ভোট প্রচলন রোধ করতে পারেনি।
জোহরান মানদানীর সঙ্গে আমার দু’বার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে; ক্লাসের জন্য অনেক মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে পারিনি, কিন্তু তার টিমের সঙ্গে কাজ করেছি। গত এক বছরে তিনি প্রতিটি ভোটারের বাড়িতে গেছেন—প্রতিটি মসজিদ, মন্দির, গির্জায় গেছেন। গ্রোসারি, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, কফিশপ—বিশ্বাস করুন, নিউ ইয়র্কে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তার পা পড়েনি। মানুষ তার পরিশ্রমের মূল্য দিয়েছে।’’




