প্রত্যাশার নির্বাচন: বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরীক্ষা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০৬:৫০ অপরাহ্ন
শফিকুল হক
অ্যাডভোকেট ও সলিসিটার
সাবেক মেয়র, টাওয়ার হ্যামলেটস
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। আসন্ন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা। দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সংঘাত এবং একপাক্ষিক পরিস্থিতির পর এবার এমন একটি নির্বাচনের পরিবেশ গড়ে উঠেছে, যা অনেকের কাছে গণতান্ত্রিক চর্চার পুনর্জাগরণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি—এই দুই প্রধান বিরোধী দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি ইতোমধ্যে বিভিন্ন সহযোগী শক্তিকে নিয়ে একটি বিস্তৃত জোট গঠনের পথে এগোচ্ছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামিও দীর্ঘ সময় পর পূর্ণ প্রস্তুতিতে নির্বাচনী ময়দানে নেমেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এই দুটি দল প্রায় সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে—যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো জামায়াতে ইসলামির অবস্থান পরিবর্তন। অতীতে তারা মূলত জোটনির্ভর রাজনৈতিক অংশীদার হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু এবার তারা সরাসরি সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং দলটির আত্মবিশ্বাস এবং নতুন ভোটার শ্রেণির প্রতি তাদের আস্থার প্রকাশ।
জামায়াতের বর্তমান আমির সম্প্রতি অতীতের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন—যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল এবং সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই আত্মসমালোচনামূলক উদ্যোগকে অনেকেই রাজনৈতিক পরিণত মানসিকতার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ দলের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা পরিবর্তন করেছে এবং তরুণ ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করেছে।
এবার জামায়াতে ইসলামি নিজেদের নির্বাচনী অঙ্গীকারে দুর্নীতিবিরোধী লড়াই, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, ন্যায্য অর্থনীতি এবং মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাদের প্রচারণায় ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট। এটি এক অর্থে অতীতের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিজেদের নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।
তবে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে জনগণের প্রত্যাশা। ভোটাররা এখন কেবল দলীয় পরিচয়ে নয়, বাস্তব ফলাফল দেখার আগ্রহে ভোট দেবে। গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক সংঘাত, দুর্নীতি ও অদক্ষতা জনগণকে হতাশ করেছে। তাই এখন তাদের বার্তা একটাই—যেই আসুক ক্ষমতায়, তাকে ডেলিভার করতে হবে। এই বার্তা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নয়, পুরো ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার পুনর্গঠনের ইঙ্গিত বহন করে।
বাংলাদেশের আগামী সরকারকে তাই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা—এই চারটি ক্ষেত্রেই জনগণ বাস্তব ফলাফল দেখতে চায়। তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে এমন নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছে, যারা ভবিষ্যৎমুখী, বাস্তববাদী এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে সক্ষম।
অতএব, এই নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। যদি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্তভাবে সম্পন্ন হয়, তবে তা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন আস্থা ফিরিয়ে আনবে। জনগণ এখন পরিবর্তন চায়—কিন্তু সেই পরিবর্তন যেন আসে দায়িত্বশীলতা, ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার পথে। এইবারের ভোট তাই কেবল নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণেরও এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।




