নিজেকে অতিরিক্ত দেখানো ক্ষতিকর কখন? মনোবিজ্ঞানীরা যা বলেন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১:৪১:৫০ অপরাহ্ন
অনুপম প্রতিবেদক: বর্তমান ডিজিটাল যুগে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। নিজের চিন্তা, ছবি, ভিডিও বা জীবনযাপনের মুহূর্ত—সবই এখন হাতের মুঠোয় ধরা ক্যামেরার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যায় বিশ্বজুড়ে। কিন্তু এই সহজ সুযোগ অনেক সময় এক ধরনের অদৃশ্য মানসিক আসক্তি তৈরি করছে—নিজেকে প্রদর্শনের ব্যাকুলতা। অনেকের অতিরিক্ত আত্মপ্রদর্শন এক ধরনের আচরণগত সমস্যা বলছেন মনোবিজ্ঞানীরা।
নিজেকে অতিরিক্ত প্রদর্শনের প্রবণতা” বলতে এমন আচরণকে বোঝায় যেখানে একজন ব্যক্তি ক্রমাগত নিজের অর্জন, প্রতিভা বা গুণের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেন এবং তা অন্যদের সামনে জাহির করার চেষ্টা করেন।
স্বাভাবিক প্রকাশ এবং অতিরিক্ত প্রকাশের পার্থক্য
নিজেকে প্রকাশ করা, নিজের অর্জন বা অনুভূতি শেয়ার করা একেবারেই স্বাভাবিক আচরণ। এটি মানুষের সামাজিক প্রবণতার অংশ।
কিন্তু যখন কেউ প্রায় প্রতিটি পোস্ট, ছবি বা ভিডিওতে নিজেকেই কেন্দ্র করে ফেলে—যখন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়েও নিজের মুখ, দেহভঙ্গি বা পোশাকই মূল আকর্ষণ হয়ে ওঠে—তখন সেটি আর সাধারণ আত্মপ্রকাশ থাকে না; সেটি হয়ে ওঠে মনোযোগ পাওয়ার এক অস্থির প্রচেষ্টা, যা ধীরে ধীরে নিজেরই ক্ষতি করে বসে।
মনোবিজ্ঞানীরা এই প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করেন “Need for validation” বা স্বীকৃতি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা হিসেবে।
অতিরিক্ত প্রদর্শনের প্রবণতার পেছনে বিভিন্ন মানসিক ও পরিবেশগত কারণ
স্বল্প আত্মসম্মান (Low Self-Esteem): প্রায়শই, এই আচরণের মূলে থাকে আত্মবিশ্বাসের অভাব বা নিজেকে মূল্যহীন মনে করার অনুভূতি। নিজেকে প্রদর্শন করে তারা বাহ্যিক বৈধতা (external validation) এবং স্বীকৃতি খোঁজে।
আঁকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার আকাঙ্ক্ষা: অনেকে সব সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করেন এবং এর জন্য নিজেদের সম্পর্কে অতিরঞ্জিত তথ্য দেন।
নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার (NPD): এটি একটি মানসিক ব্যাধি যার একটি প্রধান লক্ষণ হলো নিজের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতির অভাব।
শৈশবের অভিজ্ঞতা: শৈশবে অবহেলা, মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা বড় হয়ে নিজেদের গুরুত্ব প্রমাণ করতে এমন আচরণ করতে পারেন।
মনোবিজ্ঞানী ড. জিন টুয়েঞ্জ (Jean Twenge), যিনি “iGen” বইয়ের লেখক, বলেন—
“সোশ্যাল মিডিয়া তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মপ্রদর্শন এবং মানসিক অস্থিরতা দুই-ই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মানুষ এখন নিজেদের মূল্যের মাপকাঠি হিসেবে অন্যের অনলাইন প্রতিক্রিয়াকে ব্যবহার করছে।”
অন্যদিকে, কানাডার মনোবিজ্ঞানী ড. ক্রিস্টিন সুরসেভিল (Christine Sourieville, University of Toronto) উল্লেখ করেছেন—
“‘Validation addiction’ এখন মানসিক আসক্তির নতুন রূপ। এটি ধীরে ধীরে আত্মমর্যাদা ক্ষয়ে দেয়,
কারণ মানুষ নিজেকে যেমন, তেমনভাবে আর ভালোবাসতে পারে না।”
আরও পড়ুন—
♦ যেসব আলামত দেখে হার্ট ব্লক হচ্ছে বুঝবেন
♦ এআইয়ের পর আসছে অমিত সম্ভাবনার এজিআই
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ইচ্ছা: নিজেকে অন্যদের উপরে স্থাপন করা বা অন্যদের থেকে ভালো মনে করার প্রবণতা থেকেও এটি হতে পারে।
ভয় বা নিরাপত্তাহীনতা: কেউ কেউ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় বা নিজের অক্ষমতা প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে নিজেদের অতিরিক্ত প্রদর্শন করেন।
ক্রমে এই প্রবণতা “Self-presentation addiction” বা এমনকি “Narcissistic tendency”-তে পরিণত হতে পারে—যেখানে ব্যক্তি নিজের বাহ্যিক চেহারা বা অনলাইন প্রতিক্রিয়াকে নিজের মূল্যবোধের মাপকাঠি বানিয়ে ফেলে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোও এই প্রবণতাকে জ্বালানি দেয়। যে পোস্টে মুখ দেখা যায়, সেটি সাধারণত বেশি রিচ ও রেসপন্স পায়।
এতে ব্যবহারকারীর মস্তিষ্কে “পুরস্কার প্রক্রিয়া” (reward loop) তৈরি হয়—ফলে পরের পোস্টে আরও বেশি মনোযোগ পেতে সে আরও বেশি নিজের ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করে।
এভাবেই শুরু হয় এক অদৃশ্য মানসিক চক্র।
ফলাফল
এই অতিরিক্ত আত্মপ্রদর্শন ধীরে ধীরে বাস্তব জীবনের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। মানুষ অন্যের স্বীকৃতি ছাড়া নিজের মূল্য বুঝতে পারে না।
যখন “লাইক” কমে যায়, তখন মনে শূন্যতা, হতাশা, এমনকি হীনমন্যতা কাজ করতে শুরু করে।
মুক্তির উপায়
নিজেকে প্রকাশের ভারসাম্য শেখা জরুরি।
প্রতিটি পোস্টে মুখ না দিয়ে আপনার চিন্তা, কাজ বা মূল্যবোধ শেয়ার করুন।
নিজের সাফল্যের ভেতরের পরিশ্রম, অভিজ্ঞতা বা বার্তা তুলে ধরুন।
মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নিন—নিজেকে সময় দিন।
মনে রাখুন, আত্মসম্মান কখনোই “লাইক” বা “কমেন্ট”-এর সংখ্যায় মাপা যায় না।
নিজেকে দেখা ও দেখানো—মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু যখন “দেখো আমাকে” মানসিকতার চাপে আমরা নিজের ভেতরকার মানুষটাকেই হারিয়ে ফেলি, তখন সেটি কেবল সামাজিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও।
তাই আত্মপ্রকাশের জায়গায় যদি আত্ম-অনুধাবনকে জায়গা দেওয়া যায়, তবেই ডিজিটাল দুনিয়ার মধ্যে থেকেও আমরা মানসিকভাবে স্বাধীন থাকতে পারব।




