ই=এমসি স্কয়ার কী বোঝায়? কেন এটি অসম্পূর্ণ বলছেন বিজ্ঞানীরা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ৮:২৬:৩৪ অপরাহ্ন
সারওয়ার চৌধুরী: আলবার্ট আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের মূল ভিত্তি। এটি দেখায় যে ভর (mass) ও শক্তি (energy) আসলে একই জিনিসের দুটি রূপ, এবং একটিকে অন্যটিতে রূপান্তর করা যায়। এখানে “E” বোঝায় শক্তি, “m” বোঝায় ভর, আর “c” হলো আলোর বেগ। যেহেতু আলোর বেগের বর্গ (c2) একটি অত্যন্ত বড় ধ্রুবক, তাই এই সমীকরণ প্রমাণ করে যে অতি সামান্য ভরও বিপুল পরিমাণ শক্তির সমান। এই ভর-শক্তি সমতুল্যতাই ব্যাখ্যা করে কীভাবে সূর্যের মতো পারমাণবিক বিক্রিয়ায় (nuclear reactions) বিপুল শক্তি উৎপন্ন হয়। বিখ্যাত এই সমীকরণের অর্থ নিম্নরূপ:
ভর-শক্তি সমতুল্যতা (Mass-energy equivalence)
এই সমীকরণের মূল বার্তাটি হলো—ভর ও শক্তি একে অপরের মধ্যে রূপান্তরযোগ্য। তারা একই বস্তু বা বাস্তবতার দুটি দিক, যেগুলো একে অন্যে পরিবর্তিত হতে পারে।
স্থিতিশক্তি (Rest energy)
কোনো বস্তু স্থির অবস্থায় থাকলেও তার নিজের ভরের কারণে একটি অন্তর্নিহিত শক্তি থাকে। এই শক্তি হিসাব করা হয় তার স্থির ভর (mmm) এবং আলোর বেগের বর্গ (c2) গুণ করে।
ভর থেকে শক্তিতে রূপান্তর (Mass can become energy)
পারমাণবিক বিক্রিয়ায় অতি সামান্য ভর বিপুল শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই নীতিই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পারমাণবিক অস্ত্র উভয়ের মূল ভিত্তি।
শক্তি থেকে ভরে রূপান্তর (Energy can become mass)
উল্টো দিকেও এটি সম্ভব—শক্তি ভরে রূপান্তরিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো নির্দিষ্ট স্থানে পর্যাপ্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত হলে, তা থেকে নতুন ভরযুক্ত কণাও সৃষ্টি হতে পারে।
আলোর বেগের ভূমিকা (c2)
আলোর বেগ একটি ধ্রুবক, তবে এটি অত্যন্ত বড় সংখ্যা। এর বর্গ (c2) একটি বিশাল রূপান্তর গুণক তৈরি করে, যার কারণে অতি সামান্য ভরের মধ্যেও বিপুল শক্তি লুকিয়ে থাকে।
বৃহত্তর তত্ত্বের অংশ (Part of a larger theory)
E=mc2 যদিও সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণগুলোর একটি, এটি আসলে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের একটি সরলীকৃত রূপ। পূর্ণ সমীকরণে বস্তুর গতিশক্তিও (kinetic energy) অন্তর্ভুক্ত থাকে, কিন্তু E=mc2 অংশটি কেবল বস্তুটির স্থিতিশক্তি বোঝায়।
এই সূত্রের দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে কি?
এ সূত্র অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে (যেমন পারমাণবিক শক্তি, কণা ত্বরক, কসমিক রশ্মি ইত্যাদি) শতভাগ নির্ভুলভাবে কাজ করেছে।
তবে আধুনিক পদার্থবিদ্যার কিছু প্রসারিত ক্ষেত্র — যেমন কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি, ডার্ক এনার্জি, বা অতি-উচ্চ শক্তির কণাপদার্থবিদ্যা — এখনো এমন জায়গা যেখানে আইনস্টাইনের তত্ত্বের (বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতা উভয়ের) সীমা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
অর্থাৎ, সূত্রটি ভুল নয়, কিন্তু এটি হয়তো পুরো মহাবিশ্বের সব প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে যথেষ্ট নয় — বিশেষ করে যেখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও মহাকর্ষ একসাথে কাজ করে।
কেন বিজ্ঞানীরা বলেন E = mc² সবখানে পুরোপুরি খাটে না
সূত্রটি “বিশেষ আপেক্ষিকতা” তত্ত্বের অংশ
E = mc² আসে আইনস্টাইনের Special Relativity থেকে, যেখানে সময় ও স্থান আপেক্ষিক—
কিন্তু এখানে একটি বড় সীমাবদ্ধতা আছে:
এটি মহাকর্ষের প্রভাবকে ধরে না।
যখন খুব শক্তিশালী মহাকর্ষ কাজ করে — যেমন কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র বা বিগ ব্যাং-এর প্রথম মুহূর্তে — তখন শুধু বিশেষ আপেক্ষিকতা নয়, সাধারণ আপেক্ষিকতা (General Relativity) প্রযোজ্য হয়। সেখানে শক্তি ও ভরের সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে যায়।
কোয়ান্টাম জগতে এটি পুরোপুরি যথেষ্ট নয়
E = mc² ধ্রুবকভাবে কাজ করে “বড়” স্তরে (যেমন পরমাণু, নিউক্লিয়াস, রকেট, সূর্য)।
কিন্তু কোয়ান্টাম স্তরে, যেখানে কণা আসে ও যায় (ভার্চুয়াল কণা, শূন্য শক্তি), সেখানে শক্তি ও ভরকে আলাদা করে দেখা কঠিন।
উদাহরণ:
কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্বে বলা হয়, ভর হলো “ফিল্ডে শক্তির ঘনত্বের ফল”, অর্থাৎ শক্তিই মূল, ভর তার প্রকাশমাত্র।
তখন E = mc² সম্পর্কটা ধারণাগতভাবে ঠিক থাকে, কিন্তু গাণিতিকভাবে সরল থাকে না।
ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটারের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা
মহাবিশ্বের মোট শক্তির প্রায় ৯৫% আমরা “ডার্ক ম্যাটার” ও “ডার্ক এনার্জি” বলে জানি — কিন্তু তাদের সঠিক প্রকৃতি অজানা।
তাই E = mc²-এ থাকা E (শক্তি)-এর আসল উৎস ও রূপ নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গেছে। অর্থাৎ, সূত্রটি ভুল নয়, তবে অসম্পূর্ণ — কারণ এটি মহাবিশ্বের “অদৃশ্য শক্তি”-কে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
তথ্যসূত্র: আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের স্বীকৃত পাঠ্য ও গবেষণা (যেমন: NASA, CERN, Stanford Encyclopedia of Philosophy, ও MIT OpenCourseWare-এর ব্যাখ্যা) থেকে সংক্ষেপে উপস্থাপিত।




