ধ্বংসের ছন্দে নাচতে থাকা পৃথিবীতে লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের নিঠুর জাদু
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩৫:০৩ অপরাহ্ন
সারওয়ার চৌধুরী
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাটানট্যাঙো আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি ধরা হয়। উপন্যাসটি মূলত হাঙ্গেরির এক পরিত্যক্ত গ্রামের কাহিনি, যেখানে কিছু মানুষ এক ধরনের অচলাবস্থার মধ্যে বেঁচে আছে। চারদিক কাদায় ডুবে থাকা, অবিরাম বৃষ্টি, পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি, এবং এক মৃতপ্রায় কৃষি সমবায়—এই সব মিলিয়ে গ্রামটি যেন সভ্যতার পতনের প্রতীক হয়ে ওঠে।
এই মানুষগুলো একসময় বিশ্বাস করেছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে তাদের জীবন বদলাবে। কিন্তু বাস্তবে তারা এখন সম্পূর্ণ নিঃস্ব—তাদের শ্রম বৃথা গেছে, জমি আর ফল দেয় না, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ঠিক তখনই গুজব ছড়ায়—ইরিমিয়াস নামে এক ব্যক্তি, যাকে সবাই মৃত ভেবেছিল, সে আবার ফিরছে। তার সঙ্গে আছে পেত্রি নামে এক সঙ্গী। গ্রামের লোকজন মনে করে ইরিমিয়াস হয়তো তাদের উদ্ধার করবে, হয়তো সে নতুন করে আশা জাগাবে। কিন্তু পাঠক ধীরে ধীরে বুঝতে পারে—ইরিমিয়াস আসলে এক ধূর্ত ও কৌশলী মানুষ, যে সরকারের হয়ে কাজ করছে এবং গ্রামের সরল মানুষদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে।
শেষে দেখা যায়, ইরিমিয়াসের আগমন কোনো মুক্তির বার্তা না; এক নতুন প্রতারণার সূচনা
গল্পের কাহিনি যদিও এই সরল ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, কিন্তু Satantango কেবল একটা কাহিনি নয়—এটি মানুষের মনস্তত্ত্ব, বিশ্বাস, এবং পতনের এক গভীর দার্শনিক অন্বেষণ। ক্রাসনাহোরকাই যেন প্রশ্ন করেন: কেন মানুষ বারবার ধ্বংসের মুখেও মুক্তির আশায় বেঁচে থাকে? কেন আমরা এমন একজন নেতা বা ত্রাণকর্তার প্রত্যাশা করি, যিনি আমাদের বাঁচাবেন—যদিও বারবার সেই ত্রাণকর্তাই আমাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়?
উপন্যাসের গঠনও সাধারণ না। এতে মোট বারোটি অধ্যায় আছে, যেগুলো এমনভাবে সাজানো যে তারা একটি ট্যাঙ্গো নাচের মতো ছন্দ তৈরি করে। প্রথম ছয়টি অধ্যায় গল্পকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়, আর পরের ছয়টি অধ্যায় আবার সেই একই পথ ধরে পিছনে ফেরে। এই গঠন জীবনের পুনরাবৃত্তি, অর্থহীন ঘূর্ণি, এবং মানব অস্তিত্বের এক চক্রাকার বন্দিত্বের প্রতীক।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভাষা ঠাসবুননের, কাব্যময়, এবং প্রায় অপ্রবাহিত। একটি বাক্য কখনো কখনো কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে চলতে থাকে। যেন লেখক ইচ্ছা করেই পাঠককে শ্বাস নিতে দেন না—কারণ এই কাহিনি এমন এক বাস্তবতার, যেখানে বিশ্রামের কোনো জায়গা নেই। পাঠকও গ্রামবাসীর মতো এক নিরন্তর অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে যায়।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভাষাশৈলীর সৌন্দর্য বোঝাতে একটি ছোট ইংরেজি অনুচ্ছেদ দিচ্ছি—এটি তাঁর লেখার ধীর, প্রবাহমান, ও দার্শনিক ভঙ্গির নিদর্শন বলা যায়:
“The rain poured endlessly, as if the sky had grown tired of holding itself together and decided to dissolve upon the earth. The houses sank deeper into the mud, and the people moved like sleepwalkers, bound by a rhythm they could neither resist nor understand. Somewhere, far away, a bell rang—slowly, reluctantly—reminding them that time, too, was decaying.”
বাংলা অনুবাদ:
বৃষ্টি থামার নাম নেই—মনে হচ্ছিল আকাশ যেন নিজের ভারে ক্লান্ত হয়ে গেছে, তাই নিজেকেই গলিয়ে ফেলছে পৃথিবীর বুকে। ঘরগুলো কাদার ভেতরে আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছে, মানুষগুলো চলাফেরা করছে ঘুমন্তদের মতো, এমন এক ছন্দে বাঁধা যেটি তারা না বুঝতে পারে, না এড়াতে পারে। কোথাও দূরে একটি ঘণ্টা ধীরে, অনিচ্ছাভরে বাজছে—মনে করিয়ে দিচ্ছে যে সময়ও ধীরে ধীরে পচে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন—
হাফিজ যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন ফারসি গজল
এই ধরনের বাক্যে দেখা যায়, ক্রাসনাহোরকাই সাধারণ ঘটনাকে (যেমন বৃষ্টি বা কাদা) এমনভাবে বর্ণনা করেন যে তা এক মুহূর্তেই মানব অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে—ধ্বংস, ক্লান্তি, সময়, ও আশার মিশ্র অনুভূতিতে ভরপুর।
পুরো উপন্যাস জুড়ে বৃষ্টি, কাদা, পচন, এবং অন্ধকার—এই চারটি উপাদান একধরনের নৈরাশ্যময় সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, এই অন্ধকারের মাঝেও এক ক্ষীণ আলোর রেখা থাকে—শিল্প ও ভাষার নিজস্ব সৌন্দর্য। লেখক যেন বলতে চান, যদিও সমাজ ও মানুষ বারবার ভেঙে পড়ে, শিল্প কখনও পুরোপুরি মরে না।
শেষে দেখা যায়, ইরিমিয়াসের আগমন কোনো মুক্তির বার্তা না; এক নতুন প্রতারণার সূচনা। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস হারায়, কিন্তু তারা আবারও কোনো আশার খোঁজে তাকিয়ে থাকে। এই চক্র—বিশ্বাস, ভাঙন, আর নতুন বিশ্বাস—চলতেই থাকে, যেন এক অনন্ত ট্যাঙ্গো।
সাটানট্যাঙো তাহলে, শুধু একটি গল্প নয়; এটি আধুনিক মানবজীবনের প্রতীক—যেখানে ভয়, আশাভঙ্গ, এবং অর্থহীনতার মাঝেও কোনো না কোনো আলোর খোঁজে বেঁচে থাকার চেষ্টায় মানুষ।




