রসায়নে নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী, কী তাদের আবিস্কার?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ৯:৩৪:৪২ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: এ বছর রসায়নেও নোবেল পুরস্কার জিতেছেন তিন বিজ্ঞানী। তারা হলেন জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়া, অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড রবসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওমর এম. ইয়াগি। ধাতু-জৈব কাঠামো উদ্ভাবনের জন্য যৌথভাবে এ পুরস্কার পেয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ সময় বুধবার বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে সুইডেনের স্টকহোম থেকে এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
সুসুমু কিতাগাওয়ার জন্ম ১৯৫১ সালে জাপানের কিয়োটো শহরে। ১৯৭৯ সালে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন তিনি। বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রিচার্ড রবসনের জন্ম ১৯৩৭ সালে যুক্তরাজ্যের গ্লাসবার্নে। ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।
ওমর এম. ইয়াগির জন্ম ১৯৬৫ সালে জর্ডানের আম্মানে। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তিনি।
রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস জানায়, এই তিন বিজ্ঞানী এমন এক নতুন ধরনের আণবিক স্থাপত্য তৈরি করেছেন, যার মধ্যে গ্যাস ও রাসায়নিক পদার্থ প্রবাহিত হতে পারে। এই কাঠামো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক সম্ভাবনা তৈরি করেছে—যেমন মরুভূমির বাতাস থেকে পানি আহরণ, কার্বন ডাই-অক্সাইড ধারণ, বিষাক্ত গ্যাস সংরক্ষণ কিংবা রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করা।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান হেইনার লিঙ্কে বলেন, ধাতু-জৈব কাঠামো অসীম সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। বিজ্ঞানীরা এখন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের উপযোগী উপকরণ নিজেরাই নকশা করতে পারছেন।
তাদের এই সাফল্য ভবিষ্যতে মানবজাতির বড় কিছু সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে—যেমন পানির মধ্যে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পিএফএএস আলাদা করা, পরিবেশে থাকা ওষুধের অবশেষ ভেঙে ফেলা কিংবা মরুভূমির বাতাস থেকে পানি আহরণ।
এ বছর নোবেলজয়ীরা পাবেন একটি নোবেল মেডেল, একটি সনদপত্র এবং ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর অর্থমূল্য প্রায় ১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। কোনো বিভাগে একাধিক বিজয়ী থাকলে পুরস্কারে অর্থ তাদের মধ্যে সাধারণত সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়।
প্রতি বছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার শুরু হয় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ৬ অক্টোবর চিকিৎসাশাস্ত্র, ৭ অক্টোবর পদার্থবিদ্যা, ৮ অক্টোবর রসায়ন, ৯ অক্টোবর সাহিত্য, ১০ অক্টোবর সবচেয়ে আকর্ষণীয় শান্তিতে নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। এছাড়া ১৩ অক্টোবর অর্থনীতিতে পুরস্কারজয়ীর নাম প্রকাশের মাধ্যমে শেষ হবে এ বছরের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা।
যে কারণে নোবেল পেলেন তারা
এই তিন বিজ্ঞানী এমন এক নতুন ধরনের আণবিক কাঠামো (molecular structure) তৈরি করেছেন, যাকে আপনি একধরনের “ছিদ্রযুক্ত ঘর” বা “স্পঞ্জের মতো জাল” ভাবতে পারেন।
🔹 এই কাঠামোর ভেতরে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁকা জায়গা (ছিদ্র) থাকে।
🔹 ফলে, এই ফাঁকা জায়গাগুলোর মধ্য দিয়ে গ্যাস ও রাসায়নিক পদার্থ প্রবাহিত হতে পারে।
🔹 এর মানে, তারা এমন উপাদান বানিয়েছেন যেগুলো অণুস্তরে শোষণ, ধারণ, ও রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে পারে।
এই প্রযুক্তিকে সাধারণভাবে বলা হয় “পোরাস ম্যাটেরিয়াল” (porous materials), যার একটি বিশেষ ধরন হলো MOF – Metal-Organic Framework।
এখন এর ব্যবহার বা গুরুত্ব—
পরিবেশবান্ধব কাজে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে:
মরুভূমির বাতাস থেকে পানি সংগ্রহ: এই কাঠামো বাতাসে থাকা সামান্য জলীয় বাষ্পকে আটকে পরে তা থেকে পানি তৈরি করতে পারে।
কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) ধরা: এটি বায়ুমণ্ডল থেকে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে সংরক্ষণ করতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সহায়ক।
বিষাক্ত গ্যাস শোষণ: দূষণ বা শিল্প-দুর্ঘটনায় নির্গত গ্যাসকে নিরাপদে আটকে রাখতে পারে।
রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করা (Catalysis): অনেক শিল্পপ্রক্রিয়ায় রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্রুত ঘটানোর জন্য এ ধরনের কাঠামো ব্যবহার করা যায়।
সারকথা:
এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের অণু-স্তরে “ফাঁপা কিন্তু শক্ত কাঠামো” তৈরি করার নতুন ক্ষমতা দিয়েছে, যা ভবিষ্যতের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও শক্তি সংরক্ষণে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
এই তিন বিজ্ঞানীর একজন ওমর, যার জন্ম ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে
তিনি বিজ্ঞানীর একজন ওমর এম ইয়াঘি। জানা যাচ্ছে, ফিলিস্তিনি শরণার্থীর এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেন তিনি। ওমার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রসায়নবিদ। নোবেলজয়ী বাকি দু’জন হলেন- সুসুমু কিতাগাওয়া ও রিচার্ড রবসন। নতুন আনবিক কাঠামো বা মলিকিউলার আর্টিটেকচার উদ্ভাবনের জন্য তাদের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পান ইয়াঘি। এই তিন বিজ্ঞানী এমন কিছু আণবিক কাঠামো তৈরি করেছেন যা দিয়ে গ্যাস ও অন্য রাসায়নিক পদার্থ প্রবাহিত হতে পারে। ওই উপকরণগুলোর মাধ্যমে মরুভূমির বাতাস থেকে পানি সংগ্রহ করা, কার্বন ডাই-অক্সাইড ক্যাপচার বা বিষাক্ত গ্যাস মজুত করার কাজে ব্যবহার করা যাবে।
ইয়াঘি ২৮তম ইউসি বেকার্লির ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেন। এই বিজ্ঞানী তার ক্ষেত্রটিকে জালিকার রসায়ন বলে অভিহিত করেন। ১৯৯০ সালে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবানা ক্যাম্পেইন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। সেখানে তিনি রসায়নবিদ ওয়াল্টার ক্লেমপেরার সঙ্গে কাজ করেন। ইয়াঘি তাকে তথ্য বিশ্লেষণের কৌশল শেখান। এছাড়া কিভাবে একজন গবেষক বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত গড়ে তুলতে হয় তা শেখান। ইয়াঘি জটিল অণুগুলোর সংশ্লেষণে কাজ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে জর্ডানের আম্মানে ফিলিস্তিনি শরণার্থী এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রসায়নে নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানী ইয়াঘি। তার পিতা গবাদি পশু পালন করতেন এবং আম্মানে তার একটি মাংসের দোকান ছিলো। পিতার পরামর্শে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে যান তিনি। হাইস্কুল শেষ হওয়ার এক বছরের মধ্যে তিনি নিউইয়র্কে একা বসবাস শুরু করেন। ইংরেজিতে দুর্বল হওয়ায় তিনি ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানে হাডসন ভ্যালি কমিউনিটি কলেজ থেকে কোর্স সম্পন্ন করেন।
বলেন, রসায়নের প্রতি আমার শুরু থেকেই অন্যরকম ভালোবাসা কাজ করতো। আমি আলবানিতে চলে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে গবেষণায় মনোযোগ দেই। তিনজন পৃথক প্রফেসরের কাছ থেকে আমি তিনটি ভিন্ন ধরণের কোর্স করি। একজন প্রফেসরের কাছ থেকে ভৌত জৈব প্রকল্প, একজনের কাছ থেকে জৈব পদার্থবিদ্যা প্রকল্প ও অন্য একজনের কাছ থেকে তত্ত্ব প্রকল্প শেখেন। বলেন, গবেষণাগার আমার পছন্দ ছিলো তবে ক্লাস করতে ভালো লাগতো না। তিনি ১৯৮৫ সালে রসায়নে বিএস ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ১৯৯০ সালে আরবানা চ্যাম্পেইনের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন পোস্ট ডক্টোরাল ফেলোশিপ অর্জনের পর ১৯৯২ সালে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে, ১৯৯৯ সালে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ২০০৭ সালে ইউসিএলএতে অনুষদে অধ্যাপনা করেন ইয়াঘি।




