ডিপমাইন্ড এআই হতে পারে তরুণ সমাজের আবিষ্কারক বন্ধু
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:১৪:০৪ অপরাহ্ন
ড. শাহ জে মিয়া
ডিপমাইন্ড হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি অত্যন্ত উন্নত ধরন বা অ্যাপ্লিকেশন, যা রি-ইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ের মাধ্যমে শেখে ও উন্নত হয়। এটি আরও অভিযোজনযোগ্য এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিস্টেম তৈরিতে তাদের অগ্রগতির সাম্প্রতিক উন্নয়নগুলো অন্বেষণ করে।
ডিপমাইন্ড প্রতিষ্ঠা করেন ডেমিস হাসাবিস, শেন লেগ এবং মুস্তফা সুলেমান। তাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম বা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যা মানুষের মতো শেখার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। শেখার সঙ্গে সঙ্গে যে কোনো সম্পূরক বা অসম্পূরক সমস্যার সমাধানের ক্ষমতা অনুকরণ করতে পারে। গুগলের একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান গুগল ডিপমাইন্ড হলো একটি ব্রিটিশ-আমেরিকান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণাগার। ২০১০ সালে এটি যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০১৪ সালে গুগল এটিকে অধিগ্রহণ করে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে এটি গুগলের এআই বিভাগ Google Brain-এর সঙ্গে একীভূত হয়ে Google DeepMind হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
ডিপমাইন্ড নিউরাল নেটওয়ার্ক নামের এক ধরনের মেশিন লার্নিং মেথডকে ব্যবহার করে থাকে। এটি এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা মানুষের মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতিকে অনুকরণ ও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। ডিপমাইন্ডের মধ্যে এ নিউরাল নেটওয়ার্কগুলো বিভিন্ন স্তরে সাজানো থাকে এবং প্রচুর ডেটা থেকে শিখতে সক্ষম হয়, যার ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যকারিতা উন্নত এবং গ্রহণযোগ্য করা হয়ে থাকে। গুগলের এআই বিভাগ মনে করে, ডিপমাইন্ড প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবজাতির সবচেয়ে দরকারি আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম হতে যাচ্ছে। তারা নিরাপদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা এবং বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ডিপমাইন্ড প্রজেক্টে কাজ করছে। তাদের বিশালতা এবং ব্যাপ্তি ক্রমাগত অনুসন্ধান এবং গবেষণার মাধ্যমে আরও বড় তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ পৃথিবীকে ধারণ করছে। তারা তথ্য বিজ্ঞানের অগ্রগতির এ জগতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সমাধান আবিষ্কারকল্পে তাদের প্রতিশ্রুতি বারবার প্রমাণ করে চলছে।
২০১৪ সালে গুগলের অধিগ্রহণের পর, গুগল ডিপমাইন্ড একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিশাস্ত্র বোর্ড (artificial intelligence ethics board) গঠন করেছিল। এ বোর্ডটি এআই গবেষণার জন্য নীতিশাস্ত্রটি ব্যবহার করতে চাইলে, গুগল এবং ডিপমাইন্ড উভয়ই বোর্ডের সদস্য কারা তা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তখন গুগল ডিপমাইন্ড একটি নতুন ইউনিট খুলেছে যার নাম দেওয়া হয়, DeepMind Ethics and Society। এ ইউনিটটি আমাদের এ অত্যাধুনিক যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা উত্থাপিত নৈতিক এবং সামাজিক প্রশ্নগুলোর ওপর মনোযোগ দিতে সক্ষমতা দেখিয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মুস্তফা সুলেমান ঘোষণা করেন যে তিনি গুগলে একটি নীতিগত ভূমিকায় কাজ করার জন্য ডিপমাইন্ড ছেড়ে চলে যাবেন। পরবর্তীকালে ২০২৩ সালে, ওপেনআইএর চ্যাটজিপিটির প্রতিক্রিয়ায় গুগল ডিপমাইন্ড আরও নতুনত্ব নিয়ে আসার জন্য কাজ শুরু করে দেয়। তাদের চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে গুগল ডিপমাইন্ড এআই বিভাগ গুগল ব্রেইন-এর সঙ্গে একীভূত হয়ে গুগল ডিপমাইন্ড গঠন করে, যা কিনা অনেক নতুন নতুন ডিপমাইন্ড প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ করে চলছে। এখানে অনেক বিশ্বমানের প্রতিভাবানরা বর্তমান কম্পিউটিং অবকাঠামোকে কাজে লাগিয়ে গবেষণার পরবর্তী যুগান্তকারী অগ্রগতি এবং রূপান্তরমূলক ডিপমাইন্ড প্ল্যাটফর্ম বা পণ্য তৈরি করে চলছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালিত এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ ও নাগরিকদের সামগ্রিক সুরক্ষার কথা চিন্তা করে এসব ডিপমাইন্ড প্ল্যাটফর্মগুলো এমনভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেবাগুলো তৈরি করছে যাতে এগুলো সবার উপকারে আসে এবং মানবজাতির সবচেয়ে বড় জানা এবং আবিষ্কারের চ্যালেঞ্জগুলোকে সমাধান সম্ভব।
ডিপমাইন্ডের একটি অত্যন্ত পরিচিত অ্যাপ্লিকেশনের নাম হচ্ছে জেমিনি। জেমিনি শুরু থেকেই মাল্টিমোডাল হিসাবে তৈরি করা হয়েছে, যা টেক্সট, ছবি, অডিও, ভিডিও এবং কোডজুড়ে বিষয়বস্তুকে নিজস্বভাবে বুঝতে এবং তৈরি করতে সক্ষম। গুগল ডিপমাইন্ড ইতোমধ্যেই এ মডেলগুলো ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী ব্যবহারকারীদের কাছে, অসংখ্য পণ্য, প্রোটোটাইপ এবং ভাষায় অডিও নিয়ে এসেছে। উল্লেখযোগ্য এজন্য বলছি যে, নোটবুকএলএমের অডিও ওভারভিউ এবং প্রজেক্ট অ্যাস্ট্রা হলো এর দুটি উদাহরণ।
গুগল ডিপমাইন্ডের এই রিয়েল-টাইম অডিও ডায়ালগ অ্যাপ্লিকেশনে মানুষের কথোপকথন এতটাই সমৃদ্ধ এবং সূক্ষ্ম যে, যার অর্থ শুধু কী বলা হয় তা দিয়ে নয়, বরং কীভাবে বলা হয় যেমন স্বর, উচ্চারণ এবং এমনকি হাসি বা নন-স্পিচ ভোক্যালাইজেশন-এগুলোও অ্যানালাইসিস করে থাকে। এ অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে আমরা বলতে পারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হবে কথোপকথন। এ কারণেই জেমিনি নিজস্বভাবে অডিওতে যুক্তি ও বক্তৃতা তৈরি করে, যা কার্যকরীভাবে রিয়েল-টাইম যোগাযোগের একুরেসি বা নির্ভুলতা বাড়িয়ে দেয়।

আরও পড়ুন—
রসায়নে নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী, কী তাদের আবিস্কার?
জেমিনি কথোপকথনের সঙ্গে প্রসঙ্গ সচেতনতা নিয়ে আসতে সক্ষম। এটি যে কোনো সিস্টেমসের ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা বা আশপাশের কথোপকথন এবং অন্যান্য অপ্রাসঙ্গিক অডিওকে চিহ্নিত করতে এবং উপেক্ষা করতে প্রশিক্ষিত হয়ে থাকে। এবং জেমিনি অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে উপযুক্ত সময়ে প্রতিক্রিয়া জানানো এবং এটি কখন কথা বলতে হবে না তাও বুঝতে পারে। জেমিনি স্ট্রিমিং অডিও এবং ভিডিও থেকে নিজস্ব সমর্থন, স্ক্রিন শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে যা দেখছে তা নিয়ে ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথোপকথন করতে পারে। জেমিনি ব্যবহারকারীর কথার টোনের প্রতি সাড়া দেয়, এবং এটি বুঝতে পারে যে একই শব্দ ভিন্নভাবে বলা হলে কথোপকথন ভিন্ন হতে পারে। সর্বোপরি, জেমিনির যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তৈরির ক্ষমতা এর কথোপকথনকে উন্নতভাবে প্রকাশ করতে পারে, যা সব বৈশিষ্ট্যে সামগ্রিকভাবে আরও ভালো পারফরম্যান্স দিতে সক্ষম।
ডেভেলপারদের জন্য তৈরি গুগল এআই স্টুডিওতে জেমিনি এপিআইর মাধ্যমে অনেক ইন্টারেক্টিভ ইউজার ইন্টারফেস তৈরি করতে সক্ষম। অনুসন্ধান শুরু করার জন্য, ডেভেলপাররা গুগল এআই স্টুডিও-এর স্ট্রিম ট্যাবে জেমিনি ফ্ল্যাশ প্রিভিউর সঙ্গে নিজস্ব অডিও ডায়ালগও করতে পারে। এ ধরনের আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যাপ্লিকেশন বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে নতুন নতুন এআই অ্যাপ্লিকেশন ডিজাইনের ধারণা দিতে পারে। জেমিনির মাধ্যমে নতুন নতুন অ্যপ্লিকেশন তৈরির ধারণার উদ্ভাবন এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রোটোটাইপ তৈরির মাধ্যমে বাজারে নতুন কার্যকরী এআই সফটওয়্যার পণ্য হিসাবে নিয়ে আসা সম্ভব। এখন তরুণ প্রজন্মের জন্য দরকার হচ্ছে প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং নতুন নতুন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্র আবিষ্কার, শেখার ধৈর্য এবং যথাযথ অ্যাপ্লিকেশন ডিজাইনের পরিকল্পনা।
আগামী বছরগুলোতে আমরা দেখতে পাব কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা বা Artificial General Intelligence (AGI), যা মনুষ্য সমাজের ইতিহাসে অন্যতম সেরা রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম। এ মুহূর্তে সারা বিশ্বে বিজ্ঞানীরা, তথ্য প্রকৌশলীরা, নীতিবিদরা এবং আরও অনেকে মিলে কাজ করে চলছে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির সিস্টেমস আবিষ্কার করা যায়। আমাদের সবার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এখানে, বৈজ্ঞানিক এবং প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ সমাধান করার মাধ্যমে একটি যুগোপযোগী প্রযুক্তি তৈরি করা যা তথ্য বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে পারে, যে কোনো কাজকে সহজসাধ্য করতে পারে, বিভিন্ন সম্প্রদায়কে যথাযথ পরিষেবা দিতে পারে এবং সর্বোপরি কোটি কোটি মানুষের জীবনের উন্নতি ঘটাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
ড. শাহ জে মিয়া : প্রফেসর অব বিজনেস অ্যানালিটিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড এআই, নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া




