গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আসলে কী? গাজার কাছাকাছি পৌঁছেছে তারা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০১ অক্টোবর ২০২৫, ৯:০০:২০ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ত্রাণবাহী নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। আয়োজকরা জানিয়েছেন, নৌবহর ইসরাইলের ঘোষিত ‘বিপৎসীমায়’ প্রবেশ করেছে যা গাজার উপকূল থেকে প্রায় ১১৮ নটিক্যাল মাইল দূরে।
এই নৌবহরে মোট ৪৫টি জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি পর্যবেক্ষণ ও আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য। বাকীগুলো ত্রাণবাহী। এ যাত্রায় স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে ৪৯৭ জন।
বহুজাতিক এই অভিযানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর্মী ও প্রতিনিধি রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য এবং নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি নকোসি জোয়েলিভিলে ম্যান্ডেলা।
ফ্লোটিলা সুমুদ কাফেলায় আছেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও মানবাধিকার কর্মী শহিদুল আলম।
গ্লোবাল ফ্লোটিলা কি?
ফ্লোটিলা (Flotilla) শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ ভাষা থেকে। “Flota” মানে নৌবহর বা জাহাজবহর। এর ক্ষুদ্ররূপ বা ছোট বহরের ধারণা থেকে “Flotilla” → ছোট নৌবহর বা জাহাজের দল। আজকের দিনে এটি ইংরেজিতেও ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ একসাথে চলা ছোট জাহাজবহর বোঝাতে। সুমুদ (Sumud / صمود) শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে। এর অর্থ হলো অটলতা, দৃঢ়তা, ধৈর্য ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। বিশেষ করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনে “সুমুদ” শব্দটি একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতীক, যার মানে হলো দখলদারিত্বের মাঝেও নিজের ভূমি ও অধিকারের জন্য দৃঢ়ভাবে টিকে থাকা।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা, নেতৃত্বে গ্রেটা থুনবার্গ। এটাকে কখনো কখনো গ্লোবাল ফ্রিডম ফ্লোটিলা নামেও উল্লেখ করা হয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক, নাগরিক সমাজ-নেতৃত্বাধীন সামুদ্রিক উদ্যোগ যা ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে চালু হয়। এর লক্ষ্য গাজা উপত্যকার ওপর ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙা। এর নামকরণ করা হয়েছে আরবি শব্দ সুমুদ থেকে, যার অর্থ ‘অটলতা’ বা ‘সহনশীলতা’।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নৌবহরটি গাজার উপকূল থেকে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার (২০০ নটিক্যাল মাইল) দূরে অবস্থান করছে সমুদ ফ্লোটিশা। অংশগ্রহণকারীরা সবকিছু সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং নৌবহরের প্রতিটি জাহাজে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য জরুরি সহায়তা সংরক্ষিত রয়েছে। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, নৌবহরের সদস্যরা শান্ত এবং সজাগভাবে তাদের যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অংশগ্রহণকারীরা আশঙ্কা করছেন, ইসরায়েলি বাহিনী যেকোনো মুহূর্তে নৌবহরকে থামাতে বা আটকাতে পারে। তবে, নৌবহরের নেতা ও অংশগ্রহণকারীরা জোর দিয়ে বলেছেন, এই অভিযান শুধু মানবিক সহায়তা বহন করছে। আগামী কয়েকদিন নৌবহর গাজার উপকূলে পৌঁছানোর জন্য এগোবে, যেখানে মানবিক সহায়তা বিতরণ করা হবে।
গ্লোবাল সমুদ ফ্লোটিলা কারা
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে, আমরা একদল সাধারণ মানুষের সংঘবদ্ধ দল; যেখানে অর্গানাইজার, মানবপ্রেমী, ডাক্তার-চিকিৎসক, আর্টিস্ট, ধর্মজাযক, অ্যাডভোকেট ও নাবিকসহ নানা পেশাজীরা রয়েছে। আমরা মূলত মানবিক মর্যাদা ও অহিংস আন্দোলনের শক্তিতে বিশ্বাস করি এবং এই মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়েই কাজ করি।

ফ্লোটিলায় যোগ দিতে ২৮ সেপ্টেম্বর রওনা হওয়ার আগে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে শহীদুল আলম।
পরিচয়ে আরও বলা হয়, আমরা সম্মিলিতভাবে গত জুন মাসে স্থল, জল ও আকাশপথে বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন শুরু করি। আর গ্রীষ্মে ফিরছি এক ঐক্যবদ্ধ কৌশল নিয়ে; যেখানে অটুট লক্ষ্যে অভূতপূর্ব এক গ্লোবাল সমন্বয় রয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক সংহতির ভিত্তির ওপর আমাদের এই সংগঠন গড়ে উঠেছে। আমরা ভিন্ন ভিন্ন জাতি, ধর্ম ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী হলেও একটি সত্য আমাদের এক করেছে, অবরোধ ও গণহত্যার অবসান ঘটতেই হবে। আমরা স্বাধীন, আন্তর্জাতিক এবং কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নই। আমাদের প্রত্যয় ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা এবং মানবজীবন ঘিরে এবং এর মাধ্যমেই আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে চাই।
তথ্যমতে, এই উদ্যোগটি ২০২৫ সালের জুলাই মাসে গাজা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শুরু হয়; যা আয়োজন করে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন, গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা, এবং মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা প্রমুখ সংগঠন। এতে অংশ নিয়েছে ৫০টিরও বেশি নৌযান ও ৪৪টিরও বেশি দেশের হাজারো অংশগ্রহণকারী; যা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নাগরিক-নেতৃত্বাধীন বহর। ২০১০ সালের আগে ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙার কিছু প্রচেষ্টা সফল হলেও এরপর থেকে জাহাজগুলো ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক বা আক্রমণের শিকার হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের মে, জুন ও জুলাইয়ে কয়েকটি জাহাজে ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটে। সেপ্টেম্বরে ফ্লোটিলার ওপর তিনটি ড্রোন হামলার খবর পাওয়া যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনটি নৌযান সহায়তা দিতে পাঠানো হয়।

আবু সাঈদের ছবি আঁকা টি-শার্ট পরে গাজার কাছাকাছি শহিদুল আলম
ফ্লোটিলা ২০২৫ সালের আগস্টের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করে, যেখানে ওত্রান্তো, জেনোয়া ও বার্সেলোনা থেকে বহর রওনা হয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতে কাটানিয়া, সাইরস ও তিউনিস থেকেও বহর যাত্রা শুরু করে। কিছু কনভয় প্রথমদিকে তীব্র বাতাস ও ঝড়ের কারণে বিলম্বিত হয়। ৩ সেপ্টেম্বর ইতালীয় কনভয় সিসিলিতে পৌঁছায় এবং তিউনিসীয় জাহাজগুলো তিউনিসে একত্রিত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর স্প্যানিশ কনভয়ের একটি অংশ উত্তর তিউনিসিয়ায় পৌঁছালে ৯ সেপ্টেম্বর ভোরে একটি প্রধান জাহাজে আগুন ধরে যায়, যা ড্রোন হামলার ফল বলে সন্দেহ করা হয়। পরদিন রাতে আরেকটি জাহাজে দ্বিতীয় অগ্নিসংযোগ হামলা ঘটে। ১৯ সেপ্টেম্বর স্প্যানিশ ও তিউনিসীয় কনভয় সিসিলিতে মিলিত হয়ে গ্রিসের উদ্দেশে রওনা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর গ্রিক কনভয় মিলোস থেকে ক্রিটের উদ্দেশে যাত্রা করে এবং পরদিন পৌঁছায়।
এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে এক ডজনেরও বেশি বিদেশমন্ত্রী, ইতালীয় রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল, স্পেন ও পর্তুগালের সংসদ সদস্যরা, কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো এবং জাতিসংঘের দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেস্কা আলবানিজে।




