এস আলমের লুটপাট যেভাবে একটি শীর্ষ ব্যাংককে সংকটাপন্ন করেছে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১:৫৯:৫১ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: দেশের সেরা বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে এক সময় পরিচিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৩২ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২০২৪ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের ব্যাপক ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকটিতে বিশাল অঙ্কের প্রভিশন ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
২০২৪ সাল শেষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। যে কারণে লভ্যাংশ ঘোষণা সম্ভব হয় নি।
আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষিত রাখতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে মুনাফা থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আলাদা করে রাখতে হয়, যা লোন লস প্রভিশন নামে পরিচিত। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার সঠিক চিত্র তুলে ধরতে সম্ভাব্য খেলাপি ঋণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের হিসাব রাখা বাধ্যতামূলক। খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ইসলামী ব্যাংকের এই বিশাল প্রভিশন ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা মাত্র এক বছর আগেও ছিল মাত্র ৪ শতাংশ।
এক বছর আগেও ব্যাংকটি দেশের সর্বোচ্চ মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠান ছিল। ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা ছিল ৬৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু খেলাপি ঋণের বিপরীতে বিশাল অঙ্কের প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতার কারণে ২০২৪ সালে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড়ের সুবিধা নিয়ে ব্যাংকটি ১০৮ কোটি টাকার কৃত্রিম নিট মুনাফা দেখিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ব্যালেন্স শিটে লোকসান দেখানো হলে বিদেশি ঋণদাতাদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারত। বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনা করে ব্যাংকটিকে কৃত্রিম মুনাফা দেখানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক শ্রেণিকৃত বিনিয়োগের বিপরীতে ৬৯ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার সম্পূর্ণ প্রভিশন ঘাটতি দেখিয়েই ২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে ব্যাংকটিকে নির্দেশ দিয়েছে।
মুনাফা দেখানো সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধিনিষেধের কারণে ব্যাংকটি কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি। সম্প্রতি জারি করা এক সার্কুলারে প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড় পাওয়া ব্যাংকগুলোকে লভ্যাংশ ঘোষণা থেকে বিরত থাকতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্পূর্ণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হলে ইসলামী ব্যাংককে বিপুল লোকসান দেখাতে হতো।
১৯৮৫ সাল থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি ২০২৩ সালে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে শীর্ষ ‘এ’ ক্যাটাগরির মর্যাদা ধরে রেখেছিল। তবে ২০২৪ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা না করায় এখন এর ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবনমন হবে। ডিএসইতে কোম্পানিটির প্রত্যেক শেয়ারের দর আগের সমান ৪০ টাকাই ছিল।
এর আগে ব্যাংকটি ১৯৮৬, ১৯৮৭ ও ১৯৯২ সালে লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। লভ্যাংশ দিতে না পারার ঘটনা ব্যাংকটির ইতিহাসে এই নিয়ে চতুর্থবার এবং ৩২ বছরের মধ্যে প্রথম।
ইসলামী ব্যাংকের নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওমর ফারুক খান টিবিএসকে বলেন, সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা এতে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। কারণ ব্যাংকটির ৮২ শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিল একটিমাত্র গোষ্ঠী—এস আলম গ্রুপ। সেগুলোর মালিকানা এখন জব্দ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিশাল প্রভিশন ঘাটতি তৈরি হলেও গণঅভ্যুত্থানের পর পর্ষদ পুনর্গঠনের ফলে গত এক বছরে ব্যাংকটির তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
ফারুক বলেন, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকা ব্যাংকটির মূল অ্যাকাউন্টে অর্থ ঘাটতি ছিল। এছাড়া ব্যাংকটি সিআরআরও (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) বজায় রাখতে পারছিল না। তবে এখন মূল অ্যাকাউন্ট, সিআরআর ও অন্যান্য অ্যাকাউন্টের সব ঘাটতি উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে শুরু করায় গত ছয় মাসে ব্যাংকটি ১৫ হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছে বলেও জানান তিনি।
ফারুক আরও বলেন, ব্যাংকের দৈনিক নগদ প্রবাহ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে, ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমস্ত বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব হয়েছে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক অধিগ্রহণ করে এস আলম গ্রুপ। গ্রুপটি ২০২৪ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য পরিচিত ছিল। পরে ২০১৭ সালের অক্টোবরে কিছু স্বল্প পরিচিত কোম্পানি ব্যাংকটির শেয়ার কিনে নেয়।
তবে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) কোনো কর্তৃপক্ষই সে সময় এই অপরিচিত কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকটি এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়।
ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট প্রকৃত ক্ষতি উদ্ঘাটনে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা চালায় নবগঠিত পর্ষদ।
নিরীক্ষায় দেখা যায়, এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘন করে—প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে—প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে এবং এ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকাকালীন এসব ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করা হয়নি।
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, সরকার পরিবর্তনের পর এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম দেশের বাইরে থাকায় অধিকাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে পড়ে।বাংলাদেশ ব্যাংক তখন থেকেই এস আলম গ্রুপের জব্দকৃত শেয়ারগুলো কেনার জন্য দেশি-বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী খুঁজছে। ইসলামী ব্যাংকও ঋণ আদায়ের চেষ্টায় অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর অধীনে এস আলমের বিভিন্ন সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। সূত্র: দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও অন্যান্য




