ইসহাক দারের ঢাকা সফর: ৫ সমঝোতা স্মারক সই হবে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০২৫, ১১:০০:৫২ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দ্বিপক্ষীয় সফরে বিশেষ বিমানে করে শনিবার দুপুরে ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
রোববার তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। এ সফর ঘিরে দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে বলে কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র।
এক যুগেরও বেশি সময় পর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রা পেতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বদিচ্ছায়। সূত্র মতে, শনিবার দুপুরে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুদিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। ঢাকা সফরে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পাশাপাশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি একটি পাঁচতারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে ইসহাক দারের সম্মানে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হবে। সে আয়োজনে আঞ্চলিক দেশগুলোর (সার্কভুক্ত) প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ সফররত পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানও সেই ভোজে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
গত ২৭ এপ্রিল ইসহাক দারের ঢাকা আসার কথা ছিল। তবে ভারতের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে দেশটির সঙ্গে সীমান্তে সেসময় উত্তেজনা দেখা দিলে দারের ঢাকা সফর স্থগিত করে ইসলামাবাদ। বর্তমানে সব কিছু স্বাভাবিক থাকায় ঢাকা সফরে আসছেন ইসহাক দার।
পাকিস্তানের সঙ্গে যেসব খাতে সই হবে এমওইউ: পাকিস্তানের সঙ্গে ৬-৭টি খাতে এমওইউ বা সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এর মধ্যে ভিসা ওয়েভার-সংক্রান্ত একটি চুক্তি হবে। মূলত দুদেশের সরকারি কর্মকর্তা ও ডিপ্লোম্যাটদের জন্য এ চুক্তি হবে বলে জানিয়েছে আরেকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। এর মাধ্যমে তারা অন এরাইভাল ভিসার সুযোগ পাবেন; তবে তা সাধারণ জনগণের জন্য কার্যকর নয়। এ ছাড়া কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিস একাডেমি এবং বাংলাদেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হবে। সাংস্কৃতিক বিনিময়-সংক্রান্ত এমওইউ। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের (এপিপি) মধ্যে তথ্য বিনিময়-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এবং পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বৈশ্বিক কূটনীতি এবং বহুপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে যৌথ গবেষণা, সেমিনার আয়োজন এবং নীতিগত সংলাপ পরিচালনার সুযোগ হবে। এ ছাড়া আরও ২-৩টি এমওইউ সইয়ের বিষয় পাইপ লাইনে রয়েছে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দুদেশের মধ্যে যে কটি এমওইউ সইয়ের কথা রয়েছে তা স্থবির সম্পর্ককে সচল করবে।
আলোচনায় থাকবে আঞ্চলিক নানা ইস্যু: ঢাকায় ইসহাক দারের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মধ্যকার আলোচনায় আঞ্চলিক নানা ইস্যু প্রাধান্য পাবে। ঢাকার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করা হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তা নিয়ে কথা হতে পারে। অন্যদিকে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আঞ্চলিক আলোচনার ইস্যুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কাশ্মীর সংক্রান্ত প্রসঙ্গ আসতে পারে। এ ছাড়া বৈশ্বিক আলোচনাও হতে পারে। গাজায় যে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে তা নিয়ে উভয়পক্ষই উদ্বেগ জানাবে।
ঢাকার পক্ষ থেকে আবারও আসতে পারে একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু: ইসহাকদের ঢাকা সফরে আলোচনায় আসতে পারে বাংলাদেশ-পাকিস্তান নানা অমীমাংসিত ইস্যু, যা দীর্ঘদিন ধরে দুদেশের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের চালানো গণহত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি। গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া এবং অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদানসহ ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পাঠানো বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তরের বিষয়টিও ঢাকার পক্ষ থেকে পুনরায় উত্থাপন করা হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। যদিও এসব বিষয় স্পর্শকাতর, তবে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এগুলো আলোচনায় রাখতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা বরাবরই বলে আসছেন, শুধু একটি ইস্যুর জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নেতিবাচক হওয়ার কারণ নেই।
ইসহাক দারের বাংলাদেশ সফর অনেকটাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কূটনীতিকরা বলছেন, এর আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বাংলাদেশ সফরে এলেও তা অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময়ের মতো দ্বিপক্ষীয় সফর কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে। গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে এমন সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বদিচ্ছায়। তবে স্বাধীনতার এত বছর পর পাকিস্তানের সঙ্গে এমন সুসম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবেই দেখছেন তারা।
অন্যদিকে, বর্তমান সময়ে পাকিস্তানের বাংলাদেশের সঙ্গে এমন সুসম্পর্ক তৈরির আগ্রহকেও রাজনৈতিক হিসেবে দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড ইমতিয়াজ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান চাইছে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হোক; তবে আমাদের এটাও দেখতে হবে পাকিস্তান কি ভারতকে দেখানোর জন্য এমনটা করছে কি না। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যেহেতু ভারতের টানাপোড়েন চলছে তাই পাকিস্তান হয়তো এখন সুসম্পর্ক চাইছে। তাদের এই চাওয়াটা ভারতকেন্দ্রিক কি না, এটাও ভাবার বিষয়। তারা যে কটি এমওইউ করতে চাইছে তার বেশিরভাগই ভারতের সঙ্গেও রয়েছে। তাই এসব ইচ্ছা রাজনৈতিক হলে দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়ে নাজুক তাই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী বা আসলেই উন্নতি করতে চাইলে অর্থনৈতিক কাঠামো ও দুদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা দিয়ে হবে না।
১৯৭১ সালের অমীমাংসিত ইসুগুলো বাদ দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, পাকিস্তান এখনো ৭১ থেকে বের হতে চাইছে না; যদি তারা তা চাইতো তাহলে অনেক আগেই অমীমাংসিত বিষয়গুলো সুরাহা হতো। এ দেশের জনগণের পেনশনের টাকা, ফান্ডের টাকা তারা কেনইবা দিতে চাইবে না? এমনটা তো বলা হচ্ছে না যে টাকাগুলো একবারে মিটিয়ে দিতে হবে। বিষয়টি মিটিয়ে নিলেই সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। আর ক্ষমা চাইতে সমস্যা কোথায়। ১৯৭১-এ কিছু তো একটা হয়েছে, তা না হলে যুদ্ধ হলো কেন। তারা কেনইবা স্যারেন্ডার করেছে? গণহত্যা হয়েছে ক্ষমা চাইতে সমস্যা কোথায়। জাপান এখনো কোরিয়ার কাছে ক্ষমা চায় তাতে কী হয়েছে? সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে অবশ্যই অমীমাংসিত বিষয়গুলো সুরাহা করা উচিত।




