জুলাই সনদ: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের শেষ বড় সুযোগ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ৩:৪১:৫২ অপরাহ্ন
শফিকুল হক
সাবেক মেয়র, টাওয়ার হ্যামলেটস (লন্ডন)
সোলিসিটর ও অ্যাডভোকেট
জুলাই বিপ্লবের এক বছর পরে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রক্তাক্ত আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী সরকার পতনের পর, জুলাই চার্টার কেবল একটি সংস্কার পরিকল্পনা নয়—এটি হয়ে উঠেছে জাতীয় পুনর্গঠনের এক পরীক্ষামূলক দলিল।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) কর্তৃক প্রণীত এই চার্টার। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বে, এমন একটি জাতীয় ঐকমত্যের প্রতিফলন যেখানে রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতা এবং নাগরিক সমাজ সবাই এক কণ্ঠে কথা বলেছে।
কিন্তু এই ঐক্যের আবহ কবে পর্যন্ত থাকবে? মূল প্রশ্ন এখন আরও জোরালোভাবে সামনে এসেছে: বাংলাদেশ কি এই সুযোগকে কাজে লাগাবে, না কি আবার একটি ঐতিহাসিক সম্ভাবনা নষ্ট হবে?
একটি বিরল ঐক্যের মুহূর্ত
দীর্ঘকাল রাজনৈতিক বিভাজনে বিভক্ত একটি দেশে, জুলাই সনদ একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এতে অন্তর্ভুক্ত ১২টি মূল সংস্কার প্রস্তাব ইতোমধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে।
সংসদ সদস্যরা দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন (বিশ্বাস ভোট ও অর্থ বিল ছাড়া),
জরুরি অবস্থার সময় মৌলিক অধিকার স্থগিত করার ক্ষমতা সীমিত করা হবে,
নির্বাচন কমিশন গঠনে সরকার ও বিরোধীদল উভয়ের অংশগ্রহণ থাকবে।
এসব শুধুই কাগুজে পরিকল্পনা নয়—এগুলি সেইসব কাঠামোগত সমস্যার সমাধান যা গত এক দশকে স্বৈরাচারী শাসনের পথ তৈরি করেছিল।
অবসানহীন দ্বন্দ্ব ও আইনি অনিশ্চয়তা
তবে এখনো বহু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি না? একটি দ্বিতীয় কক্ষ (Upper House) গঠন করা হবে কি না? নারী সংরক্ষিত আসন কীভাবে সংস্কার হবে? রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হবে।?
এসব বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—চার্টার বাস্তবায়নের আইনগত ভিত্তি কী হবে?
কেউ বলছে, এটি জনভোটের মাধ্যমে অনুমোদন পেতে হবে। কেউ বলছে, রাষ্ট্রপতির আদেশ (Legal Framework Order) এর মাধ্যমে কার্যকর করা হোক। আবার কেউ চায়, আগামী সংসদে আইন পাশ করে কার্যকর করা হোক।
এই অনিশ্চয়তা সনদের বিশ্বাসযোগ্যতা হুমকির মুখে ফেলছে।
গঠনমূলক সংস্কার, না কি পুরনো ক্ষমতার নতুন মোড়ক?
সত্যি কথা হলো, এর আগেও আমরা বহুবার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি শুনেছি।
১৯৯০-এর পর, ২০০৬-এর পর, এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনেও। প্রতিবারই ‘গণতন্ত্র’ নামক ব্যানারে পুরনো স্বার্থই ফিরে এসেছে।
কিন্তু জুলাই বিপ্লব আলাদা ছিল। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের তৈরি করা আন্দোলন ছিল না। এটি এসেছিল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে, সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে—যারা দুঃশাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ছিল।
তাদের দাবি ছিল স্পষ্ট: একটি রাষ্ট্র যেখানে আইনের শাসন থাকবে।
জুলাই সনদ সেই দাবির প্রতিফলন। এটি ভুলে গেলে, তা হবে দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
পরবর্তী দুই বছর হবে নির্ধারক
সনদে উল্লেখ আছে: পরবর্তী নির্বাচনের পর গঠিত সংসদের দুই বছরের মধ্যেই সংস্কারগুলো সম্পূর্ণ করতে হবে।
অর্থাৎ আগামী নির্বাচন শুধু একটি সরকার গঠনের বিষয় নয়—এটি হবে নতুন যুগের ভিত্তি স্থাপন, বা পুরনো চক্রে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
এই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর জাতীয় দায়িত্ব আছে: তারা কি সনদকে বাস্তব রূপ দিতে পারবে?
ভঙ্গুর এক আশার শেষ অবলম্বন
জুলাই সনদ নিঃসন্দেহে ত্রুটিমুক্ত নয়। তবুও এটি আমাদের সামনে একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছে—যেখানে ন্যায়বিচার, জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক নৈতিকতা গুরুত্বপূর্ণ।
এই সনদ এখনো বাস্তব নয়—এটি এখনো এক ভঙ্গুর আশা। কিন্তু যদি আমরা সবাই—রাজনীতি, সমাজ ও নাগরিক—চাই, তাহলে এটিকে বাস্তবে রূপান্তর করা সম্ভব।
বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো একটি সুযোগ পেয়েছে। আমরা কি এটিকে কাজে লাগাবো, না কি ইতিহাসে আরেকটি ব্যর্থতা যুক্ত করব?




