সিলেট: এক বছর আগের ১৯ জুলাই শহিদ হন সাংবাদিক তুরাব
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১:১২:৫৩ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি: শহীদ সাংবাদিক এ টি এম তুরাবের শাহাদতের ১ বছর পূর্ণ হলো আজ। এই ১ বছরে দেশে অনেক কিছুই হলো। কেবল শেষ হয়নি তুরাব হত্যার বিচার। এক বছরে অর্জন কেবল ২ জন আসামি গ্রেফতার আর তদন্ত।
জানা গেছে, নগরীর ব্যস্ততম এলাকা কোর্টপয়েন্টে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের গুলিতে নিহত হন দৈনিক নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান আবু তাহের মো: তুরাব (এ টি এম তুরাব)। এরপর কেটে গেছে এক বছর। এই সময়ে এসএমপির কোতোয়ালি থানা, পিবিআই হয়ে মামলাটি এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-আইসিটিতে। অপেক্ষা বাড়ছে বিচারের। মৃত্যুর আগে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান শহীদ তুরাবের মা, স্বামী হত্যার বিচার দেখতে চান বিয়ের ৩ মাসের মাথায় প্রিয়জনকে হারানো স্ত্রী ও তুরাবের ভাই-বোনরা।
গত বছরের ১৯ জুলাই বাদ জুমা নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে মিছিল বের করে ছিল বিএনপি। তখন ন্যূনতম কোনো উত্তেজনা ছিল না। নিত্যদিনের মতো সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন অনেক সাংবাদিক। পাশেই ছিল পুলিশের সশস্ত্র অবস্থান। হঠাৎই অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তা এসএমপির তৎকালীন সহকারী কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরের মারমুখী আচরণে বদলে যায় পরিস্থিতি। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কোর্টপয়েন্ট এলাকা। ওই পুলিশের কিলিং মিশনের টার্গেটে পড়ে যান সাংবাদিক এ টি এম তুরাব। পুলিশের ছোড়া ৯৮টি ছররা গুলি বিদ্ধ হয় তুরাবের শরীরে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে জরুরিভিত্তিতে সোবহানীঘাটস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই আইসিইউতে থাকা অবস্থায় সাংবাদিক তুরাব সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তুরাবের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা: শামসুল ইসলাম বলেন, তুরাবের শরীরে ৯৮টি ছররা গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায়ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
মাত্র তিন মাস আগে লন্ডনি মেয়ে বিয়ে করেছিলেন সাংবাদিক এ টি এম তুরাব। লন্ডন যাওয়ার সব প্রক্রিয়া এগিয়েও রেখেছিলেন। হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে তার লন্ডন পাড়ি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয় তাকে। এমন ঘটনায় হতবাক হয়ে পড়ে তার পরিবার। লন্ডনে থাকা সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী তানিয়া ইসলাম বিয়ের তিন মাসের মধ্যে হয়ে যান বিধবা। এখনো কাঁদছেন তিনি। কারণ তখন দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় স্বামীর লাশ ও শেষ বিদায়ের দৃশ্য দেখতে পারেননি তিনি। সাংবাদিক তুরাব হত্যার এক বছর পেরিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তুরাব হত্যা মামলায় এসএমপির তৎকালীন এডিসি সাদেক কাউসার দস্তগীর ও পুলিশ কনস্টেবল উজ্জ্বল সিংহ কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু এসএমপির তৎকালীন ডিসি আজবাহার আলীসহ এজাহারভুক্ত অধিকাংশ আসামি এখনো বাইরে থাকায় ন্যায়বিচার নিয়ে পরিবার ও সহকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে সংশয়।
যেভাবে গুলি, যেকারণে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন তুরাব
২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট। জুমার নামাজের পর সিলেট নগরীর কালেক্টরেট মসজিদের সামনে থেকে মিছিল বের করে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসময় সড়ক বিভাজকে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন দৈনিক নয়াদিগন্ত ও দৈনিক জালালাবাদের রিপোর্টার আবু তাহের মোহাম্মদ তুরাব (এটিএম তুরাব)। মিছিলটি কোর্ট পয়েন্ট থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে যাওয়ার পরই পেছন থেকে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করে পুলিশ। বিভাজক থেকে নেমে সড়ক পার হওয়ার চেষ্টা করেন তুরাব। সিলেট ভ্রমণ গাইড
এসময় এক কনস্টেবলের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে তুরাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েন সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) সহকারী পুলিশ কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীর। প্রেস লেখা ভেস্ট পরা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন তুরাব। প্রথমে তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তুরাব মারা যান।
তুরাবকে গুলি করার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হলে দাবি ওঠে তাকে টার্গেট কিলিং করা হয়েছে। প্রেস লেখা ভেস্ট শরীরে থাকাবস্থায় সাংবাদিক পরিচয় জেনেই এডিসি দস্তগীর এক কনস্টেবলের রাইফেল কেড়ে নিয়ে গুলি করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তুরাবকে কেন টার্গেট করেছিলেন এডিসি সাদেক কাউসার দস্তগীর। সিলেট ভ্রমণ গাইড
জানা গেছে, এটিএম তুরাব তার পত্রিকায় ক্রাইম নিউজই বেশি করতেন। পুলিশের অপরাধ নিয়েও লেখালেখি করতেন তিনি। এতে ক্ষিপ্ত ছিলেন সিলেট কোতোয়ালী থানার সাবেক সহকারী কমিশনার (পরবর্তীতে অতিরিক্ত উপকমিশনা পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) সাদেক কাউসার দস্তগীর।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি সিলেট নগরীর নাইওরপুলে একটি দুর্ঘটনার সংবাদ সংগ্রহে যান তুরাব। এসময় এডিসি দস্তগীর ও কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদের আক্রমনের শিকার হন তিনি। এডিসি দস্তগীরের নির্দেশে ওসি আলী মাহমুদ ও একজন উপপরিদর্শক (এসআই) সাংবাদিক তুরাবকে লাঠিচার্জ করেন। এর প্রতিবাদ করতে গেলে দৈনিক কালবেলার ব্যুরো প্রধান মিঠু দাস জয়ও লাঞ্ছিত হন।
তুরাবের সহকর্মীদের অভিযোগ, এটিএম তুরাবের পেশাগত দায়িত্ব পালন নিয়েই তার উপর ক্ষোভ ছিল এডিসি দস্তগীরের। সেই ক্ষোভের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল নাইওরপুলে। আর শেষটা ঘটেছে জুলাই আন্দোলনে কোর্ট পয়েন্টে। তুরাবকে হত্যার উদ্দেশ্যেই টার্গেট করে গুলি ছুঁড়েছিলেন দস্তগীর।
তুরাব গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় তার সাথে ছিলেন দৈনিক কালেরকন্ঠের আলোকচিত্রি আসকার আমিন রাব্বি ও দৈনিক মানবজমিনের আলোকচিত্রি মাহমুদ হোসেন। আসকার আমিন রাব্বি জানান, এডিসি দস্তগীর যেখানে দাঁড়ানো ছিলেন সেখান থেকে সাংবাদিকদের অবস্থান পরিস্কার ছিল। তুরাবের পরণে প্রেস লেখা ভেস্টও দৃশ্যমান ছিল। একজন কনস্টেবলের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তিনি যেভাবে গুলি করেছেন তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, তুরাব টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে।
তুরাবকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন তার কর্মস্থল দৈনিক জালালাবাদের সম্পাদক মুকতাবিস উন নূরও। তিনি বলেন, তুরাব পত্রিকায় অপরাধ বিষয়ক সংবাদ করতো। তুরাবের মৃত্যুর পর অফিস থেকে তিনি জানতে পেরেছেন এডিসি দস্তগীরের সাথে একদিন তুরাবের কথা কাটাকাটিও হয়েছে। এই রেশ থেকেই দস্তগীর তুরাবকে হত্যা করেছেন। তুরাবকে হত্যা করতে এডিসি দস্তগীর হয়তো জুলাই আন্দোলনের নৃশংসতাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।
এদিকে, তুরাব হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া এডিসি সাদেক কাউসার দস্তগীর ও কনস্টেবল উজ্জ্বল সিংহকে আগামী রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তোলা হচ্ছে। বর্তমানে মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ১৩ মে যুক্তরাজ্য প্রবাসী তানিয়া ইসলামকে বিয়ে করেন সাংবাদিক এটিএম তুরাব। একমাস পর স্ত্রী চলে যান যুক্তরাজ্যে। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকায় সেসময় মৃত স্বামীর মুখও দেখতে পারেননি তানিয়া। হত্যাকান্ডের ঘটনায় তুরাবের বড় ভাই আবুল আহসান মো. আজরফ জাবুর বাদি হয়ে প্রথমে কোতোয়ালী থানায় ও পরে আদালতে মামলা দায়ের করেন।




