ইসরায়েল চট্টগ্রাম-খুলনার চেয়েও ছোট, যেভাবে গঠিত হয়
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০২৫, ১:৪৫:০০ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইরান। এই দুই দেশের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার কারণে হতাহতের তালিকাও ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।
এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের দেশ দু’টো থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। সঙ্কট সমাধানে আলোচনার কথা বলছে বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ।
ইসরায়েলের ভৌগোলিক অবস্থান
এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত ইসরায়েলের পশ্চিম দিকে ভূমধ্যসাগর এবং পাশে রয়েছে লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, মিশর এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড।
ইসরায়েলের সঙ্গে গাজা উপত্যকার পূর্ব ও উত্তর দিকের সংযোগ থাকলেও সেখানে কঠোর চেকপোস্ট রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ দিকে মিশরের সাথে গাজার সীমান্ত রয়েছে, যেখানে রাফাহ ক্রসিং অবস্থিত। এটিই গাজা ভূখণ্ডের জন্য একমাত্র সীমান্ত পথ।
ইসরায়েলের আয়তন কত?
ইসরায়েল সরকারের দাবি অনুযায়ী, দেশটির আয়তন ২২ হাজার ১৪৫ বর্গকিলোমিটার। এ দিক থেকে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিভাগ চট্টগ্রামের চেয়েও ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি ছোট। এমনকি খুলনা বিভাগ থেকেও সামান্য ছোট।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, তাদের মোট আয়তনের ২১ হাজার ৬৭১ কিলোমিটারই ভূমি। এর দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪২৯ কিলোমিটার এবং প্রস্থ মাত্র ১১ কিলোমিটার।
ইসরায়েলের দাবি করা এই আয়তনের মধ্যে রয়েছে মূল ভূখণ্ড, গোলান মালভূমি, জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজার মতো আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত অঞ্চল।
ইসরায়েলের জনসংখ্যা
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা ৯৫ লাখ ১২ হাজার ৩৯৪ জন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে চারশোরও কম মানুষ থাকে।
ইসরায়েল একটি ইহুদি রাষ্ট্র হলেও সেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অন্যান্য ধর্মের অনুসারীও বসবাস করেন। জার্মানির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ‘স্ট্যাটিস্টা’ অনুযায়ী, জনসংখ্যার বিচারে দেশটিতে ইহুদীদের পরেই রয়েছে ইসলাম ধর্মালম্বীরা। এছাড়া, সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খ্রিস্টান ও দ্রুজ ধর্মেরও মানুষ বসবাস করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, বিশ্বের মোট ইহুদীদের অর্ধেকের কিছুটা কম সংখ্যক মানুষ ইসরায়েলে বসবাস করে। বাকি প্রায় অর্ধেক বাস করে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্সের মতো দেশেও কিছু সংখ্যক ইহুদী আছে।
ইসরায়েলের প্রধান শহর কতগুলো
ইসরায়েলের জাতীয় লাইব্রেরির তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় ৮০টি শহর রয়েছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ শহর এলাকায় থাকে। এর মধ্যে সিংহভাগই আবার বড় শহরে থাকে, বাকিরা থাকে ছোট শহরে। মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের বসবাস গ্রামে।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শহর হলো জেরুজালেম। ২০২২ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, সেখানে প্রায় নয় লাখ ৭০ হাজার লোকের বসবাস।
তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ থাকে মাত্র ইসরায়েলের ১৬টি বড় শহরে। সাধারণত কোনো এলাকায় ২০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করলে সেটিকে সেখানে বড় শহর বলা হয়। এই শহরগুলোর বেশিরভাগই ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান নগরী তেল আবিবের আশেপাশে।
ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কেন্দ্র হলো এই তেল আবিব। বিশ্বের অনেক দেশ জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস না রেখে তেল আবিবে রেখেছে। জেরুজালেম ও তেল আবিব ছাড়াও হাইফা, রিশোন লে জিয়ন, পেতাহ টিকভা, বিয়ার শেভা, নাজারেথ, এলাটও দেশটির বেশ গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত।
ইসরায়েল যেভাবে গঠিত হয়
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফিলিস্তিন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। এটি মুসলিম, ইহুদী এবং খ্রিস্টান– এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত।
তখন ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদীরা ব্যাপক বিদ্বেষ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সেখান থেকেই ‘জাওনিজম’ বা ইহুদীবাদী আন্দোলনের শুরু। তাদের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বাইরে কেবলমাত্র ইহুদীদের জন্য একটি রাষ্ট্র পত্তন করা। ইহুদীবাদী আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপের ইহুদীরা দলে দলে প্যালেস্টাইনে গিয়ে বসত গাড়তে শুরু করে। কিন্তু তাদের এই অভিবাসন স্থানীয় আরব এবং মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। সেসময় আরব এবং মুসলিমরাই ছিল সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙ্গে পড়ে এবং পরবর্তীতে প্যালেস্টাইনে তখন আরব জাতীয়তাবাদী এবং ইহুদীবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। ইহুদী এবং আরব মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেভাবে লাখ লাখ ইহুদীকে হত্যা করা হয় (হলোকাস্ট), তারপর ইহুদীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চাপ বাড়তে থাকে।
তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার পর যে ‘লিগ অব নেশনস’ গঠিত হয়েছিল, তাদের পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ‘ম্যান্ডেট’ দেয়া হয় প্যালেস্টাইন শাসন করার। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা এই অঞ্চলটি তখন ফিলিস্তিনি আর ইহুদীদের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল।
কিন্তু পরদিনই মিশর, জর্দান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলে। সেটাই ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইহুদীদের কাছে এটি স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনে আরবদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অঞ্চলটি বরাদ্দ করেছিল, এই যুদ্ধের পর তার অর্ধেকটাই চলে যায় ইসরায়েলের দখলে। ফিলিস্তিনের জাতীয় বিপর্যয়ের শুরু সেখান থেকে।
এটিকেই তারা বলে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে হয়। ইহুদী বাহিনী তাদেরকে বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ করে। ওই যুদ্ধ ছিল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের সূচনা মাত্র।
এরপর ১৯৬৭ সালে আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল ছয় দিন। ৫ জুন হতে ১০ জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধে ইসরায়েল বিপুলভাবে জয়ী হয়।
তারা তখন একদিকে মিশরের নিয়ন্ত্রণে থাকা গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়। অন্যদিকে, পূর্ব জেরুসালেম-সহ পশ্চিম তীরও তারা দখল করে নেয় জর্দানের কাছ থেকে। সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে গোলান মালভূমি। ফলে আরও পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়ি-ঘর ফেলে পালাতে হয়।
আরব-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাসে এর পরের যুদ্ধটি ‘ইয়োম কিপুর’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের এই যুদ্ধের একদিকে ছিল মিশর আর সিরিয়া, অন্যপক্ষে ইসরায়েল। মিশর এই যুদ্ধে সিনাই অঞ্চলে তাদের কিছু হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করে। তবে গাজা বা গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলকে হটানো যায়নি।
এই যুদ্ধের ছয় বছর পর ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে মিশর। এরপর তাদের পথ অনুসরণ করে জর্দানও।
সূত্র: বিবিসি বাংলা




