সাহিত্য পুরস্কার পেলেন সাহিত্যিক সেজান মাহমুদ, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলা সমাপ্ত
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২৫, ৯:৩৮:৩৪ অপরাহ্ন
ইভান হোসেন, নিউইয়র্ক থেকে: লোকে লোকারণ্য নিউইয়র্কের জয়া হল। ২৪ মে শনিবার দুপুর ১২টা। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন খ্যাতিমান লেখিকা তসলিমা নাসরিন। এবারের বইমেলার আহ্বায়ক বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধার নিয়ে তৈরি। উদ্বোধন করছেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বেলাল বেগ।
সকলের হাতে জাতীয় পতাকা। ধীর পায়ে সবাই এগিয়ে যাচ্ছেন বুকস্টগুলোর দিকে। সামনেই ফিতা। ফিতা কেটেই উদ্বোধন ঘোষণা করলেন বেলাল বেগ। এভাবেই সাক্ষী হলেন হল ভর্তি হাজারো মানুষ। একটি ইতিহাস রচিত হলো, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলা’র যাত্রা শুরুর ক্ষণের।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে অভিবাদন জ্ঞাপনের পর সমস্বরে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্যদিয়ে ২৪ মে দুপুরে নিউইয়র্কে শুরু হয়। দুদিনের ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলা’য় শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণী, নির্বিশেষে সর্বস্তরের প্রবাসীর ঢল নেমেছিল।
এবারের আয়োজক ছিল ‘একাত্তরের প্রহরী’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম। এই বইমেলায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন খ্যাতিমান লেখক তসলিমা নাসরিন। ছিলেন ভারত, বাংলাদেশ ও প্রবাসের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক-লেখক-মানবাধিকার সংগঠকরা।
বক্তব্য দেওয়ার সময় বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদি-জঙ্গিদের প্রাণনাশের হুমকিতে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন বলেন, ৩১ বছর যাবত নির্বাসিত জীবন-যাপন করছি। আমি নিজের দেশে যেতে পারি না। যে পশ্চিমবঙ্গে বাস করছিলাম সেখানেও নিরাপত্তাহীনতা, সেখানেও এখন আমার স্বাধীনতা নেই। এখানে আমি এসেছি শুধু দেখতে যে, কী ঘটছে এখানে। এই সিটিতেই আরেকটি বইমেলা হচ্ছে, শুনেছি ওখানে সবাই জয় বাংলার পক্ষে নয়, তাই ঐ বইমেলা (মুক্তধারা আয়োজিত মেলার প্রতি ইঙ্গিত করে) অনেক বড় এবং পুরনো জানা সত্বেও আমি ওখানে যাবার ব্যাপারে কোন আগ্রহ প্রকাশ করিনি। আমি এখানে এসেছি কারণ, আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ।
তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের পক্ষের মানুষ এবং স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। আমি এখানে এসেছি এবং আপনাদের আবারো ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমাকে এইভাবে সম্মান জানানোর জন্যে। কারণ আমি জানি ঐ বইমেলায় এমন অনেক মানুষ থাকবে যারা নারী বিদ্বেষী, যারা আমাকে ওখানে একেবারেই সম্মান জানাবে না, তা আমি জানি। সুতরাং আপনারা যে আন্তরিকতা দেখালেন তা আমি চিরকাল মনে রাখবো। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনির মধ্যে তসলিমা উচ্চারণ করেন, আপনারাই আমার দেশ। এখানে এসে এই যে ভালবাসা আমি পাচ্ছি সেই ভালবাসাই আমাদের দেশ।

মেলায় প্রবর্তিত এবারের সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার কলেজ অব মেডিসিনের অধ্যাপক ও সহকারি ডিন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টম গ্র্যাজুয়েশনকারি কবি, সাহিত্যিক, গীতিকবি, ছড়াকার এবং কলামিস্ট সেজান মাহমুদ। নগদ দুই হাজার ডলারসহ বিশেষ সম্মাননা ক্রেস্ট বিপুল করতালির মধ্যে হস্তান্তর করেন মেলা কমিটির আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক ড. নুরুন্নবী এবং বিজ্ঞানী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. জিনাত নবী। এর আগে এই সাহিত্য পুরস্কারের প্রেক্ষাপট ও সেজান মাহমুদের বর্ণাঢ্য সাহিত্য-কর্মজীবন উপস্থাপন করেন প্রবাসের আরেক জনপ্রিয় কবি-কলামিস্ট-সংগঠক ফকির ইলিয়াস। ফুল দিয়ে লেখককে বরণ করেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম।
এওয়ার্ড হস্তান্তরের সময় পাশে ছিলেন বইমেলার সদস্য-সচিব স্বীকৃতি বড়ুয়া এবং আবৃত্তিশিল্পী গোপন সাহা। উল্লেখ্য, এই সাহিত্য পুরস্কার প্রতিবছরই বইমেলায় একজনকে প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় এবং তা স্পন্সর করবে ‘ড. নবী ও জিনাত নবী ফাউন্ডেশন’। আর এ পুরস্কারের নাম হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বইমেলা নবী-জিনাত সাহিত্য পুরস্কার’।
সময়ের প্রয়োজনে ‘আমরা বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অবিচল’ স্লোগানে আয়োজিত এই বইমেলার জন্যে গঠিত কমিটির কর্মকর্তাগণের মধ্যে বক্তব্য দেন যুগ্ম আহবায়ক ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি আব্দুল কাদের মিয়া, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. ফজলুল হক, মানবাধিকার সংগঠক-লেখক-অধ্যাপক ড. পার্থ ব্যানার্জি, ডেমক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার ড. দিলীপ নাথ, কম্যুনিটি লিডার রানা হাসান মাহমুদ, অধ্যাপক এ বি এম নাসের, সাংবাদিক দস্তগীর জাহাঙ্গির, সাংস্কৃতিক সংগঠক লুৎফুন্নাহার লতা, মিথুন আহমেদ, ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান জাকারিয়া চৌধুরী প্রমুখ। সমসাময়িক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চমৎকার একটি মুক্ত আলোচনার সঞ্চালনা করেছেন মিনহাজ আহমেদ সাম্মু।
গোপন সাহা, সাবিনা শারমিন এবং তাহরিনা পারভিন প্রীতির সাবলিল উপস্থাপনায় উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন আল আমিন বাবু এবং জাতীয় সঙ্গীতে নেতৃত্ব দেন নিলোফার জাহান। বিদ্যাপ্রকাশ,
নালন্দা, ঘুংঘুর, শব্দগুচ্ছ, অক্ষর, জয় বাংলা পাঠাগার, বিপা, অনুপমা বুকস, রাইটার্স ক্লাব, জয় বাংলা বুকস, আমরা শিশুদের সঙ্গী, গুরুচণ্ডালী, একাত্তরের প্রহরী সহ মেলায় ছিল ১৬ টি বুক স্টল-যেখানে ছিল দেশ ও প্রবাসের খ্যাতিমান লেখকদের প্রকাশিত নতুন বইয়ের পাশাপাশি ইতিহাসভিত্তিক গবেষণা গ্রন্থ।
মেলার সকল আয়োজনকে ছাপিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক জনমত সুসংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালনকারি ‘স্বাধীনতায় ডাক টিকিট’র ডক্যুমেন্টারি প্রদর্শনের সাথে বিরাঙ্গনাদের ওপর নির্মিত ‘জননী-৭১’র প্রদর্শন।
মাত্র ১০ দিনের প্রস্তুতিতে অনুষ্ঠিত এ বইমেলায় এসেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া, নর্থ ক্যারলিনা, ওহাইয়ো, ওয়াশিংটন ডিসি, ফ্লোরিডাইংল্যান্ড, কানাডা, জার্মানী সহ বিভিন্ন স্টেট ও দেশের কবি-লেখক-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরাও। জনপ্রিয় শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নির জাগরণী সঙ্গীতের মাধ্যমে গভীর রাতে প্রথম দিনের অনুষ্ঠানমালার সমাপ্তি ঘটার আগে সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি পর্বে ছিলেন আবীর আলমগীর, কান্তা আলমগীর, সেলিমা আশরাফ, নিলোফার জাহান, পারভিন সুলতানা, শুক্লা রায়, জারিন মাইশা, কামেলা সোফি আলম, আমিনা ইসলাম, রুদ্রনীল দাস রুপাই, পিঙ্কি চৌধুরী, পাপড়ি বড়ুয়া, দিনার মনি, আনিশা হোসেন, দানিয়া সৈয়দ দিয়া, এলমা রুদমিলা, লিমন চৌধুরী, ফারহানা তুলি, তন্ময় মজুমদার, জিএইচ আরজু, মুমু আনসারী প্রমুখ।
বইমেলার দ্বিতীয় দিন ২৫ মে রবিবার অনুষ্ঠানমালা শুরু হয় বিকেল ছয়টায়। উদ্বোধনী ঘোষণার পর, এবং প্রামাণ্য চিত্র ‘জাতির যাদুঘর’ চরদর্ঢন করেন শামিম আল আমিন।
এরপরেই ছিল শিশু কিশোর পরিবেশিত আবৃত্তি অনুষ্ঠান ‘শৈশবের হাতছানি’। সঙ্গীত ও আবৃত্তিতে অংশ নেন বিদিশা দেওয়ানজী, মিথুন আহমেদ, তাহরিনা পারভিন।
নবীন মেলায় ছিলেন তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা। সঙ্গীতে ফাবিহা নিসা এবং জাহিন হোসেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ছিল ঠিক এর পরেই।
‘অভিবাসে দায়িত্বশীল সাহিত্য ও নতুনপ্রজন্মের সম্পৃক্তি’- শীর্ষক সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন, বিশিষ্ট মুক্তচিন্তক ও লেখক আসলাম আহমাদ খান।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বিশিষ্ট গল্পকার ও কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি। তিনি তাঁর লেখায় অনুবাদের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেন। বলেন, আমাদের প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূল চেতনা পৌঁছে দিতে হলে তা ইংরেজীতে অনুবাদ করতে হবে। এই বিষয়ে তিনি বিভিন্ন রেফারেন্স দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য প্রয়াসের বিষয়টি তুলে ধরেন। এই সেমিনারে অংশ নেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক বদিউজ্জামান খসরু ও সমাজচিন্তক-রাজনীতিক রাফায়েত চৌধুরী।
স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ছড়াকার মনজুর কাদের।
পরের পর্বে সঙ্গীত ও আবৃত্তিতে অংশ নেন- শেলি চন্দ, লিপি রোজারিও এবং শাহরিয়ার সালাম। প্রামান্যচিত্র ‘অবিনশ্বর ৭১’ সকলের মন কাড়ে সেই একাত্তরের চেতনায়।

সঙ্গীত ও আবৃত্তিতে ছিলেন সুতপা মণ্ডল, তাহমিনা শহিদ, শারমিন আক্তার, বিলকিস রহমান দোলা, উত্তর আমেরিকার বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী রাজীব ভট্টাচার্য যখন মঞ্চে আসেন তখন হল ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ শুরু করে বেশ কয়েকটি গান তিনি গেয়ে শোনান দরদি কন্ঠে।
এরপরেই বাজে বিদায়ের সুর। রাত তখন বারোটা। মেলার সদস্য সচিব স্বীকৃতি বড়ুয়ার আহ্বানে, যুগ্ম আহ্বায়ক
তাজুল ইমাম মঞ্চে গিয়ে ঘোষণা করেন সমাপ্তি। জানান এই বইমেলা আগামী বছর থেকে হবে আরও অনেক বৃহৎ পরিসরে। যে-মেলা বিশ্বের বাঙালি সমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে তা ক্রমশ ব্যাপ্তী লাভ
করবে বিভিন্ন দেশে।
দুই দিনের এই বইমেলায় ইংরেজি বইয়ের বিপণন ও তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছিল খুবই আশাব্যঞ্জক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার এই যে প্রত্যয়, তা ছিল খুবই আশা জাগানিয়া।


