পূর্ব লন্ডন: একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ মার্চ ২০২৫, ৭:২৭:৫৭ অপরাহ্ন
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, লন্ডন: একাত্তরের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার নজির বলে উল্লেখ করেছেন বক্তারা। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে পঁচিশে মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে। একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পরিকল্পিত এই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে ২৫শে মার্চ মঙ্গলবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আয়োজনে ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে পালিত হয়েছে জাতীয় গণহত্যা দিবস। অনুষ্ঠানের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং রণাঙ্গনে যে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন এবং শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক জুয়েল রাজের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম।
সৈয়দ এনাম তাঁর বক্তব্যে ২৫শে মার্চ কাল রাত্রিতে অপারেশন সার্চ লাইট নাম দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির উপর কিভাবে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা তুলে ধরেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ঘাতকদের বিচারের জন্য মহিয়সী নারী শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমির মাতা শ্রদ্ধেয় জাহানারা ইমাম একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যে গঠন করেছেন তার বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলেও অধিকাংশ যুদ্ধাপরাধী এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে, সে সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যারা হত্যাযজ্ঞ সাধন করেছে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
গণহত্যা দিবসকে স্মরণ করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত যে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধারা বক্তব্য রাখেন তাঁরা হলেন, লোকমান হোসেন, ফয়জুর বহমান খান, সংগঠনের উপদেষ্টা আবু মুসা হাসান ও গৌস সুলতান। মুক্তিযোদ্ধারা সকলেই তাঁদের বক্তব্যে বলেন, ২৫শে মার্চ সারা দেশে এবং সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢুকে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারীদের হত্যা করেছে হানাদাররা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম … প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, শুনে তাঁরা উদ্ধুদ্ধ হয়েছিলেন এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁরা আরো বলেন, ২৫ শে মার্চ যেমন বিভীষিকাময় কাল রাত্রি, তেমনি প্রতিরোধের রাতও বলা যায়। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং আমরা নিজেরাও বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেট তৈরি করে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি সেদিন।
তাঁরা বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সর্বাত্মক এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল সমানভাবে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নারীর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বাছ-বিচারহীনভাবে। ২৫শে মার্চ যেমন হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নি সংযোগ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেশকে ছারখার করে দিয়েছে হানাদাররা। শুধু ঢাকা শহর নয়, সারা দেশেই এই গণহত্যা হয়েছে। একাত্তরের ১২ই মে খুলনার চুকনগরে এক দিনেই ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে হানাদাররা। তাঁরা আরো উল্লেখ করেন, বুড়িগঙ্গা নদীর কূলে জিঞ্জিরায় এবং সৈয়দপুর ও মিরপুরে গণহত্যা হয়েছে বেশী।
গণহত্যা স্মরণ অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক সভাপতি সৈয়দ আনাস পাশা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ড. আনসার আহমেদ উল্লাহ, সহ-সভাপতি নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, সহ -সভাপতি জামাল আহমেদ খান, সহকারী সাধারণ সম্পাদক শাহ বেলাল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুনিরা পারভীন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্মৃতি আজাদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দা নাজনীন শিখা, সংগঠনের উপদেষ্টা কবি হামিদ মোহাম্মদ, সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী, টিভি উপস্থাপক ঊর্মি মাযহার, নাজমা রহমান, উদিচীর সভাপতি নুরুল ইসলাম, সিপিবির সহকারী সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার বিন আলী, জাসদ এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কবি মজিবুল হক মণি, সাংস্কৃতিক কর্মী শাহাবুদ্দিন বাচ্চু, অসীমা দে, সৈয়দ হামিদুল হক, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ এর সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আহাদ চৌধুরী, সাবেক ডিপুটি মেয়র শহীদ আলী, শতরূপা চৌধুরী, এম এইচ মিঠু, রানা মাহের, লিপি ফেরদৌসী প্রমুখ।
উপস্থিত বক্তারা একাত্তরে বাংলাদেশে যে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা হয়েছে তার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির দাবী জানান।
কালরাত্রির স্মরণ অনুষ্ঠানে গণহত্যা নিয়ে স্বরচিত কবিতা ‘আমি বীরাঙ্গনা’ পাঠ করেন কবি ও অভিনয় শিল্পী মাহফুজা তালুকদার। তিনি কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নারীদের উপর অত্যাচারের নিদর্শন তুলে ধরেন তাঁর কবিতায় ‘…আমি বীরাঙ্গনা- আমি দেখেছি মৃত্যু আর মৃত্যু, রক্ত আর রক্ত, লাশ আর লাশ… আমি কিছু ভয়ঙ্কর শয়তান, দালাল, বেঈমানদের সহায়তায় হিংস্র পাষন্ড পৈশাচিক পশুদের উদগ্র লালসার শিকার।’
কবিতার পর সংগীত শিল্পী শতরূপা চৌধুরীর নেতৃত্বে সমবেত কন্ঠে পরিবেশিত হয় দেশাত্মবোধক গান ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ এবং জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ড. আনসার আহমেদ উল্লাহ উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ঘাতকদের বিচারের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।