স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, সুস্থতার প্রতিশ্রুতি আর রমজানের পবিত্রতা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মার্চ ২০২৫, ১০:১৪:৩১ অপরাহ্ন
তামান্না হাসনাত চৌধুরী, ভার্জিনিয়া থেকে: দেখতে দেখতে পবিত্র রমজানের বিশ দিন শেষ হয়ে এলো। এ মাসের শুরুতেই আমরা নানা পরিকল্পনা করি, আত্মশুদ্ধির প্রত্যয়ে পথচলার প্রস্তুতি নিই এবং মনপ্রাণ উজাড় করে ইবাদতে মনোনিবেশ করতে চাই। রমজান শুধু সংযম ও ধৈর্যের মাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের এক মহিমান্বিত সুযোগ।
এ মাসের প্রধান লক্ষ্য হলো মহান আল্লাহ তায়ালাকে বেশি করে স্মরণ করা, তাঁর অশেষ রহমত ও মাগফিরাতের জন্য বিনম্র প্রার্থনা করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে যত্নবান হওয়া, কোরআন তেলাওয়াতে গভীর মনোযোগ দেওয়া, এবং সময় বের করে অতিরিক্ত নফল ইবাদতে মনোনিবেশ করা।
ইফতার শেষে প্রতিটি রাত যেন তারাবির স্নিগ্ধতায় ও ইবাদতের আলোতে উদ্ভাসিত হয়, সে দিকে বিশেষ মনোযোগী হওয়া।
রমজান কেবল আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মাস নয়, এটি পরিবারের প্রতি যত্নশীলতা ও দায়িত্ববোধেরও প্রতীক। বিশেষ করে গৃহিণীদের জন্য এ মাসটি এক অনন্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, যেখানে সেহরী ও ইফতারের আয়োজন একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে ওঠে। আমাদের কাছে ইফতার মানেই ছোলা, বুট, পেঁয়াজু ও বাহারি ভাজাপোড়া খাবারের সমাহার, যা প্রতিদিন রোজা রেখে গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
রমজানের প্রকৃত শিক্ষা হলো আত্মসংযম, সুস্থতা ও ভারসাম্য বজায় রাখা। তাই আমাদের উচিত ইফতারে পরিমিত ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা, যা শরীরকে চাঙ্গা রাখবে এবং সুস্থতা নিশ্চিত করবে। প্রচুর পানি পান, ফলমূল ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সংযোজন আমাদের মনকে সতেজ ও শরীরকে প্রাণবন্ত রাখে। তাই ইফতারের আয়োজনের ক্ষেত্রে সচেতনতা জরুরি, যেন আমাদের খাবার শুধু রুচিসম্মতই না হয়, বরং তা স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকরও হয়। রমজানের সত্যিকারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে ইফতারের টেবিলে পরিমিতি, স্বাস্থ্য ও সংযমের সমন্বয় থাকা উচিত।
বিশেষ করে যে সব বাড়িতে স্কুল পড়ুয়া ছোট ছেলেমেয়েরা রোজা রাখছে, তাদের কথা মাথায় রেখে টেবিলে স্বাস্থ্যকর ও মুখরোচক খাবার রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি পুষ্টিকর ও ভিন্নধর্মী কিছু খাবার সংযোজন করলে ইফতারের পরিবেশ আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সুস্থতা ও সংযমের মূল শিক্ষা অনুসরণ করে, যদি আমরা পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পারি, তবে রমজানের প্রকৃত বরকত ও সৌন্দর্য আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারবো।
কিছুদিন আগে ভিয়েতনাম ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল আমার। প্রতিবার নতুন কোনো দেশে গেলে, আমার প্রধান আকর্ষণ থাকে সেখানকার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, খাবারদাবার এবং মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা। ভিয়েতনামে গিয়ে আমি বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছি তাদের পরিশ্রমী স্বভাব ও স্বাস্থ্যসচেতন জীবনধারা দেখে।
ভিয়েতনামের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার Pho, একটি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর স্যুপ, যা সারা দেশেই জনপ্রিয়। বিশেষ করে হ্যানয় শহরের রাস্তার ধারে ছোট ছোট গোল টেবিল ও রঙিন পিঁড়ি পেতে মানুষজনকে বড় বড় বাটিতে এই Pho উপভোগ করতে দেখা যায়। পুরো শহর জুড়ে এ যেন এক নিত্যদিনের দৃশ্য!
রমজানের প্রকৃত শিক্ষা হলো আত্মসংযম, সুস্থতা ও ভারসাম্য বজায় রাখা। তাই আমাদের উচিত ইফতারে পরিমিত ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা, যা শরীরকে চাঙ্গা রাখবে এবং সুস্থতা নিশ্চিত করবে।
হ্যানয়ে পৌঁছানোর পরই আমরা প্রথম রাতে একটি হালাল রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করি এবং সেখানেই প্রথমবারের মতো বিখ্যাত Pho স্যুপের স্বাদ নেই। এই স্যুপ যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। আজ বাড়িতে ইফতারের জন্য স্বাস্থ্যকর কিছু তৈরি করতে গিয়ে আমি এই স্যুপটি বেছে নিলাম। পরিবারের সবাই দারুণ উপভোগ করে খেয়েছেন, যা আমাকে আনন্দিত করেছে।
তাই ভাবলাম, আমার পাঠকদের সাথেও এই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্যুপের রেসিপিটি শেয়ার করি, যাতে আপনাদের ইফতারেও স্বাস্থ্যকর ও ভিন্ন স্বাদের একটি বিশেষ খাবার যুক্ত হয়।
নীচে আপনাদের সুবিধার জন্য ভিয়েতনামিজ Pho স্যুপ তৈরির রেসিপিটি শেয়ার করলাম। আশা করি আপনাদেরও ভালো লাগবে!
Pho প্রস্তুতের জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো প্রথমেই দেখে নিই। আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপকরণের পরিমাণ ঠিক করব।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
স্যুপের জন্য: হাড়সহ মুরগির মাংস, হাড় ছাড়া মুরগির বুকের মাংস, পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি, বড় আকারের একটি পেঁয়াজ (দুই ফালি করে কাটা), কিছু আদাকুচি, সামান্য দারুচিনি, এলাচ ও লবঙ্গ, অল্প পরিমাণ ফিশ সস, লেবুপাতা ও কাঁচা মরিচ।
সবজি হিসেবে: মাশরুম, বীন স্প্রাউট, পালংশাক।
গার্নিশিংয়ের জন্য: পেঁয়াজকলি ও ধনেপাতা।
অতিরিক্ত: সিদ্ধ করা কিছু রাইস নুডুলস।
প্রস্তুত প্রণালি:
চিকেন স্টক তৈরি করা:
একটি বড় পাত্রে অল্প পরিমাণ তেল গরম করুন। এতে কাটা পেঁয়াজ ও আদাকুচি দিয়ে দিন। পেঁয়াজ ও আদা হালকা বাদামি হয়ে সুগন্ধ ছড়ালে তাতে পানি ঢেলে দিন। এরপর এতে হাড়সহ মুরগির মাংস, হাড় ছাড়া মুরগির বুকের মাংস, পরিমাণমতো লবণ, দারুচিনি, এলাচ ও লবঙ্গ দিয়ে আধা ঘণ্টা সিদ্ধ করুন। শেষে কিছু গোলমরিচ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে আরও কিছুক্ষণ রান্না করুন। হয়ে গেলে, স্টক ছেঁকে শুধু তরল অংশ আলাদা করে নিন। এরপর স্টক থেকে মুরগির বুকের মাংস তুলে নিয়ে পাতলা স্লাইস করে কেটে রাখুন।
রাইস নুডুলস সিদ্ধ করা:
প্যাকেটের নির্দেশনা অনুযায়ী রাইস নুডুলস সিদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে নিন।
পরিবেশন:
একটি বড় বাটিতে সিদ্ধ করা রাইস নুডুলস ছড়িয়ে দিন। এরপর একে একে পালংশাক, বীন স্প্রাউট, মাশরুম এবং স্লাইস করা মুরগির মাংস দিন। সবশেষে, ওপর থেকে গরম চিকেন স্টক ঢেলে দিন। গার্নিশিংয়ের জন্য কিছু ধনেপাতা ও পেঁয়াজকলি ছড়িয়ে দিন। ইচ্ছে করলে Sriracha সস ও লেবুর রস দিয়ে পরিবেশন করুন।
আমার বাড়ির সবাই এই Pho স্যুপ দারুণ উপভোগ করেছেন, তাই ভাবলাম আপনাদের সাথেও শেয়ার করি! আশা করি আপনাদেরও ভালো লাগবে। নিশ্চিন্তে একবার ট্রাই করে দেখুন, এই স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু স্যুপ আপনার ইফতার টেবিলে বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করবে। আর হ্যাঁ, একটু যত্ন নিয়ে সুন্দরভাবে সাজিয়ে পরিবেশন করলে পুরো টেবিলের পরিবেশই বদলে যায়! কারণ আমরা সবাই জানি—“আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী”।
আপনার ইফতার হোক মজাদার ও পুষ্টিকর!
রমজানের পবিত্রতা ও সুস্থতার প্রতিশ্রুতি বজায় রেখে, আমরা সংযমী হই, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করি এবং ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভের আশায় শেষ কয়েকটি দিন খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে কাটাই।