মুক্তির জন্য সমাজ বিপ্লবের দরকার
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৪:৪৬ অপরাহ্ন
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
রাষ্ট্র এখন একটি চরম ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করেছে। কোনো এক দেশে নয়, প্রায় সব দেশেই। বুর্জোয়ারা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জয়ধ্বনি দিয়ে থাকে, সেই বুর্জোয়া গণতন্ত্র চরম অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। পৃথিবীজুড়ে প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষমতা দখল করছে।
ইতালিতে মুসোলিনির পার্টি আবার চলে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন ব্যক্তি, নানা কারণে যিনি অপরাধী, যৌন নিপীড়নের জন্য যিনি অপরাধী সাব্যস্ত, সেই ব্যক্তি পুনরায় জনরায়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আমরা দেখি, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ছদ্ম-ফ্যাসিবাদীরা ধর্মকে ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়লাভ করার কৌশল নিয়েছে। কাজেই লেনিন যে রাজনৈতিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন, সেই বিপ্লবের প্রয়োজন আজকেও আছে; আজকে বরং আরো বেশি করেই আছে। পৃথিবী এখন একটি চরম ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছে।
প্রশ্নটি দাঁড়িয়েছে মানুষের সভ্যতা চলতি পথে এগিয়ে খালের মধ্যে নেমে পড়বে, নাকি পুরোপুরি যান্ত্রিক হয়ে যাবে। এটি কোনো বানানো কল্পনা নয়, এটি বাস্তব সত্য। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যক্তিমালিকানার পৃথিবীর চরম দুর্দশা, দেখতে পাচ্ছি সেই পৃথিবী বিপদের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।
মানুষের অগ্রগতির যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের অন্তরে ব্যক্তিমালিকানার শক্তি বৃদ্ধির কাহিনিই নিহিত রয়েছে।
আদিম সাম্যবাদী সমাজকে বাদ দিয়ে একের পর এক যেসব সভ্যতা এসেছে, তাদের প্রতিটিই উন্নতির একেকটি পর্যায়বিশেষ; বিশেষ করে পুঁজিবাদী সভ্যতা তো চরম বস্তুগত উত্কর্ষে গিয়ে পৌঁছেছে। তবে এই অগ্রগতির মধ্যে যে জিনিসটি গোপন নেই, সেটি হলো মানুষ চরম দুর্গতির মধ্যে আছে। করোনাভাইরাসের যে আক্রমণ ঘটল, সেই আক্রমণ পুঁজিবাদের প্রতিরূপ এবং তার ভেতরে পুঁজিবাদের যে মূলবার্তা ব্যক্ত, সেটিও ছিল। বার্তাটি হলো এই যে তুমি যদি বাঁচতে চাও, তবে তুমি একদা যে আদিম গুহায় থাকতে, সেই গুহায় চলে যাও। তোমার কোনো সামাজিক জীবন থাকবে না, তোমার আপনজন বলে কেউ রইবে না, তুমি বন্ধুকে শত্রু মনে করবে, নিকটজনের সঙ্গে মিলবে না।
তুমি তোমার প্রাগৈতিহাসিক একাকিত্বের জায়গায় চলে যাও, নিজেকে বাঁচাও। এই রকম মহামারি আবারও আসতে পারে। তবে আরেকটি বড় দুশ্চিন্তা মুক্তির জন্য সমাজ বিপ্লবের দরকার কড়া নাড়াচ্ছে। যেটি আসছে, সেটি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগমন ধ্বনি। আজকে আমরা এ কথাও শুনতে পাচ্ছি যে এই শিল্প বিপ্লবের একটি বড় অবদান হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর ওই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নাকি পৃথিবীকে প্রাচুর্যে ভরে দেবে! মানুষের কোনো কষ্ট থাকবে না, শ্রমিকের কায়িক শ্রমের প্রয়োজন হবে না, শ্রম ও পুঁজির কোনো দ্বন্দ্ব বাধবে না এবং পৃথিবী নাকি মহাশান্তির বিশ্রামাগারে পরিণত হবে। কিন্তু সেই পৃথিবী যে কত ভয়ংকর হতে পারে, সেটি হয়তো আমরা এখনো কল্পনা করতে পারছি না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শাসিত সেই পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ বেকার হবে। এরই মধ্যে বেকার হওয়া শুরু হয়ে গেছে। প্রাচুর্য আসবে ঠিকই, কিন্তু ওই প্রাচুর্যের ন্যায়সংগত বিতরণ ঘটবে না।
বিশ্বপুঁজিবাদের নৃশংস আগ্রাসনের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে কী করতে হবে, সেটি আজ খুব জরুরি প্রশ্ন। এটি পরিষ্কার যে মুক্তির জন্য সমাজ বিপ্লব দরকার হবে, কিন্তু সে বিপ্লবের জন্য বিপ্লবী পার্টি চাই, যে পার্টিটি আমরা গড়তে পারছি না। বিপ্লবী পার্টি গড়া ছাড়া তো বিপ্লব সম্ভব নয়। সঙ্গে সঙ্গে দরকার হচ্ছে বিপ্লবী তত্ত্ব। আর এই বিপ্লবী তত্ত্বের জন্য চাই জ্ঞানের অনুশীলন।
ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে যাঁরা বিপ্লব করবেন মনে করতেন, লেনিন তাঁদের উপহাস করেছেন। ট্রেড ইউনিয়ন কোনো বিপ্লবী সংগঠন নয়; তার কাজ অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা নয়। ট্রেড ইউনিয়নে শ্রমিক ও মালিক পরস্পরের প্রতিপক্ষ ঠিকই, কিন্তু তারা আবার একও। এই অর্থে এক যে উভয় পক্ষই বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে মেনে নেয়। মেনে নিয়ে মালিক চায় শ্রমিককে ঠকাবে, শ্রমিক চায় কিছু বেশি মজুরি আদায় করবে। লড়াইটি দর-কষাকষির এবং তা ওই বৃত্তের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। ট্রেড ইউনিয়ন বড়জোর চাইবে শ্রমিকদের পক্ষে কিছু নতুন আইন তৈরি হোক। কিন্তু শ্রেণি সম্পর্কে পরিবর্তন আনা এবং বিপ্লবের লক্ষ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা ওই আন্দোলনের এখতিয়ারের বাইরে। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু তার জন্য তাকে অবশ্যই সচেতন করতে হবে। মজুরিসচেতন নয়, শ্রেণিসচেতন। আর এই শ্রেণি সচেতনতাটি আপনা-আপনি, ভেতর থেকে আসবে না; সে আসবে বাইরে থেকে। সচেতনতা সঞ্চারিত করার দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন হবে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীর। বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাকে লেনিন মূল্য দিতেন। তাঁদের তো তিনি বলতেন পেশাদার বিপ্লবী। তিনি নিজে ছিলেন এই পেশাদার বিপ্লবীদেরই একজন। বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরাই পারবেন মেহনতি মানুষের সঙ্গে এক হয়ে তাদের সচেতন ও সংগঠিত করতে। বিপ্লব মেহনতি মানুষের নেতৃত্বেই হবে, কিন্তু সেই শ্রেণি যদি সচেতন ও সংগঠিত হয়, তবেই পারবে নিজেকে এবং সেই সঙ্গে সমাজের অপর সব শ্রেণিকে মুক্ত করতে। সংগঠিত না হলে জনগণ কিছুই নয়, সংগঠিত হলে তারা সব কিছু, লেনিন শিখিয়েছেন। সংগঠিত হতে হলে একটি পার্টি চাই। এই পার্টি হবে বিপ্লবের অগ্রবাহিনী। সর্বদাই সে থাকবে সামনে; কখনোই পেছনে নয়। লেজুড় হবে না। না শ্রমিকের, না বুর্জোয়ার, না ঘটনার। পার্টিতে একাধারে থাকবে গণতান্ত্রিকতা ও কেন্দ্রিকতা। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি নয়, একসঙ্গেই থাকতে হবে উভয়কে। পার্টিতে নির্বাচন হবে, সমালোচনাও চলবে, এমনকি ক্ষুদ্রাংশও সমালোচনা করতে পারবে বৃহদংশের। কিন্তু পার্টি অবশ্যই হবে সুশৃঙ্খল। সমালোচনা পার্টি ভাঙার লক্ষ্যে করা হবে না, সুসংগঠিত করার লক্ষ্যেই করা হবে।
‘‘….বার্তাটি হলো এই যে তুমি যদি বাঁচতে চাও, তবে তুমি একদা যে আদিম গুহায় থাকতে, সেই গুহায় চলে যাও। তোমার কোনো সামাজিক জীবন থাকবে না, তোমার আপনজন বলে কেউ রইবে না, তুমি বন্ধুকে শত্রু মনে করবে, নিকটজনের সঙ্গে মিলবে না।….’’
একসময় দেখা গেছে, বিপ্লবীদের মধ্যে একটি অংশ ছিল, যারা সন্ত্রাসে বিশ্বাস করত। তারা ভাবত, হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করবে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেবে। যেমন আমাদের নিকটকালের নকশালপন্থীরা ভেবেছেন। লেনিন এই চিন্তাকেও প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিই তাঁকে বলে দিয়েছে, জনগণ যদি সমাজসচেতন, সংগঠিত এবং প্রকাশ্য শ্রেণিসংগ্রামে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সুশিক্ষিত না হয়, তাহলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা ভাবা যায় না। লেনিন পার্টিকে গোপন রাখার কথা বলেছেন, বিশেষ করে তাঁর সময়ে জারদের অতিনৃশংস অত্যাচারের কারণে। তাই বলে গোপন ও সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় বিপ্লব হবে—এ রকম বিশ্বাস তাঁর ছিল না। বিপ্লব বলতে তো তিনি আসলে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বুঝতেন না, গোটা সমাজের রূপান্তর বুঝতেন। এবং সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তনও চাইতেন। সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেওয়ার এই আবশ্যকতার দিকে পরবর্তী মার্ক্সবাদীরা, বিশেষ করে গ্রামসি যে বিপ্লবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, সে কাজ লেনিন গ্রামসির আগেই করে গেছেন। যেভাবে অতিশয় গুরুত্ব দিয়ে লেনিনের আগে করেছেন মার্ক্স ও এঙ্গেলস। জনগণকে সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন করতে না পারলে বিপ্লব সম্ভবপর নয়—এ প্রত্যয় থেকেই লেনিন অবিরাম প্রবন্ধ ও গ্রন্থ লিখেছেন এবং সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন। বারবার বলেছেন, সচেতন করো, শ্রেণিসচেতনতা বাড়িয়ে তোলো, নইলে বিপ্লব সম্ভব হবে না। পার্টি সংগঠনকে তিনি বড় করে দেখেছিলেন। কেননা বিশ্বাস করতেন, সংগঠন ভিন্ন মুক্তি নেই।
এতে কিন্তু একটি ঝুঁকিও ছিল। সেটি হলো পার্টির ও রাষ্ট্রের অভিন্ন হয়ে যাওয়া। বুর্জোয়া শাসকরা যেমনটি করতে পছন্দ করেন। সেটি না হয় থামানো গেল, কিন্তু আসল শঙ্কা হলো, বিপ্লবের পরে পার্টিতে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং রাষ্ট্রও শেষমেশ আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রে পরিণত হয়ে যাবে। যে স্বতঃস্ফূর্ততাকে তিনি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, নিজেদের বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রেই তা রক্ষিত হয়নি। মর্মান্তিক সত্য হলো, তাঁর নিজের দেশে আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রকে কবজা করে ফেলেছিল। বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে লেনিন নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিলেন। আশা করেছিলেন, রাষ্ট্র ক্রমাগত অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে।
আমলাতন্ত্রের গোপন ও ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধির দরুন রাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনীয় করাটা সম্ভব হয়নি। জনগণ নতুন এক আমলাতন্ত্রকেই সামনে দেখতে পেয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিই বিরূপ হয়ে উঠেছিল। তদুপরি বিপ্লবের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আগের মতো পশ্চাৎপদ ছিল না, লোকজন আগের দিনের দারিদ্র্য ভুলে গিয়েছিল এবং লেনিন যে সংস্কৃতিসচেতনতাকে অগ্রসর করে নেওয়ার ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, সেই কাজটিও অবহেলিত হওয়ার দরুন মানুষ পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ে যাওয়ায় বিপদটা ঘটে গেছে।
কিন্তু উত্পীড়িত মানুষের জন্য লেনিন সর্বদাই প্রাসঙ্গিক। কেননা বিপ্লব ভিন্ন উত্পীড়িতের মুক্তি নেই। যেখানেই বিপ্লব, সেখানেই লেনিন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদী পাকিস্তানের গ্রাস থেকে মুক্ত হয়েছিল; মাও জেদংও তাঁর দেশকে উপনিবেশবাদী-সামন্তবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। মাও যেহেতু লেনিনবাদী ছিলেন, তাই তিনি জানতেন কী করতে হবে। জানতেন যে পুরনো রাষ্ট্রকে চূর্ণবিচূর্ণ করে নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা চাই। আর শেখ মুজিব যেহেতু লেনিনের পথ ধরেননি, পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্রের বুর্জোয়াকাঠামো, তার আইনকানুন ও আমলাতন্ত্র ভেঙে নতুন রাষ্ট্র গড়বেন—এটি যেহেতু তিনি আবশ্যক মনে করেননি, তাই রাষ্ট্রকে তিনি আরো শক্তিশালী করলেন এবং সামরিক আমলাতন্ত্রের একাংশের হাতে অতিনির্মমভাবে নিহত হলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে পুঁজিবাদের জন্য পথ আরো প্রশস্ত হলো, জনগণ কষ্টার্জিত স্বাধীনতার ফল পেল না। মুজিব সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁর দল মোটেই সমাজতন্ত্রী ছিল না। দল ছিল হবু বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক সংগঠন। তবে এটিও তো সত্য যে লেনিনও আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং সেটি ঘটে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কয়েক মাসের মধ্যেই। প্রতিবিপ্লবীরা সাংঘাতিক বস্তু, রাষ্ট্র ভাঙলেও তারা ভাঙে না। (কালের কণ্ঠের সৌজন্যে)
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়