মানবিকতা জাগিয়ে তোলার প্রত্যয়ে বার্মিংহামে সম্প্রীতি কনসার্ট
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৭:৫১ অপরাহ্ন
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান বার্মিংহাম থেকে ফিরে: ‘আমরা দুর্জয়, আমরা হারবোনা’- এমন স্লোগানে মানবিকতা জাগিয়ে তোলার প্রত্যয়ে মধ্য ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত হলো সম্প্রীতি কনসার্ট। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বুকে ধারণ করেন এমন মানবিক মানুষগুলো জড়ো হয়েছিলেন ঐ কনসার্টে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আকুতি জানিয়ে তাঁরা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ আজ ভালো নেই, মাতৃভূমির এই ক্রান্তিলগ্নে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য আজ বড়ই প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা জাগিয়ে তোলার আজ আর কোন বিকল্প নেই।
১৬ ফেব্রুয়ারি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘পূর্বানাট’ এর সহযোগিতায় সফলভাবে তৃতীয়বারের মত অনুষ্ঠিত এই সম্প্রীতি কনসার্টে শিল্পীদের গাওয়া দেশাত্মবোধক ও মানবতাবাদী গানে উপস্থিত সব মানুষ কন্ঠ মিলিয়েছেন একসাথে। কনসার্টের সর্ব সম্মত ঘোষণায় বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থান রক্ষার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে সবার প্রতি।
সম্প্রীতি কনসার্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী ঊর্মি মাজহারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই সম্প্রীতি সমাবেশে যখন শিল্পীদের কন্ঠে গীত হচ্ছিলো-
“ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে
তা থৈ তা থৈ থৈ দিমি দিমি দ্রম দ্রম
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে
দানব দলনী হয় উন্মাদিনী
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে
সাজ রে সন্তান হিন্দু-মুসলমান
থাকে থাকিবে প্রাণ, না হয় যাইবে প্রাণ, নিতে হয় মুকুন্দেরে নিও রে সঙ্গে।’ -এমন গান, তখন পুরো হলে বিরাজ করছিলো অন্যরকম এক অবয়ব।
একের পর এক জাগরণী গান ও দেশের গান গেয়ে শোনান শিল্পীরা। সদ্য প্রয়াত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করে স্বনামধ্য শিল্পী গৌরী চৌধুরী অশ্রু সজল চোখে গেয়েছেন ‘আমি বাংলাকে ভালবাসি, আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি..।’ এই গানের সাথে দর্শক সারির প্রায় সকলের চোখও সিক্ত হোয়ে যায়।
পুরো অনুষ্ঠান সফল করতে ‘পূর্বানাট’ এর সংগঠক মুরাদ খান, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব প্রশান্ত পুরকায়স্থ, সাংবাদিক জুয়েল রাজ, সংস্কৃতিকর্মী স্মৃতি আজাদ, নজরুল ইসলাম অকিব, ফটোগ্রাফার জি আর সোহেলসহ লন্ডন ও বার্মিংহামের একঝাঁক মুক্তমনা মানুষের বিরামহীন কর্মচাঞ্চল্য উপস্থিত সবার দৃষ্টি কেড়েছে। সঙ্গীত পরিবেশনার নেতৃত্বে ছিলেন, প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী গৌরি চৌধুরী ও সঞ্জয় দে।
‘সম্প্রীতি’র প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক ঊর্মি মাজহার বলেন, সম্প্রীতি কনসার্ট একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন । আমরা রাজনীতি বা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করিনা। আমরা এই যে মানুষগুলো একত্রিত হয়েছি এটা একটি শক্তি, আমরা মানুষের বোধকে বদলাতে পারি। চিন্তাকে বদলাতে পারি মানুষের মাঝে অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের বীজ ছড়াতে পারি। আর সেই চেষ্টাই করে চলছি।
পূর্বানাট’র পক্ষে মুরাদ খান বলেন, এই ধরণের আয়োজনের আয়োজক হিসাবে পূর্বানাট একটি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। এই সম্প্রীতি শুধু বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি নয় পুরো বিশ্বজুড়েই অস্থিরতা চলছে। বিভাজন নয় আমরা একটি মানবিক বিশ্ব দেখতে চাই। এই ধরনের আয়োজন আমাদের সেই শক্তি দেয়। মানুষের মাঝে সুন্দর বার্তা পৌঁছে দিবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে মঞ্চে আয়োজকদের পক্ষ থেকে পাঠ করা হয় ঘোষণাপত্র । সেখানে বলা হয়, “আমরা ঘোষণা করছি যে সম্প্রীতি কনসার্ট ইউকে একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক আন্দোলন। বাংলাদেশের হাজার বছরের লালিত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে আমরা একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মিলিতভাবে একই মঞ্চে কাজ করে যাব। যে চেতনা ও বিশ্বাস থেকে ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ৩ লক্ষ মা- বোনের জীবন-মান বিসর্জন এবং লাখো মুক্তিযোদ্ধার জীবনপণ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে আমরা বাংলাদেশের সর্বত্র সেই সব অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আমরা আমাদের কর্ম, চিন্তা ও চেতনায় মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি পরম আস্থা এবং মানব সত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধাবোধ ধারণ ও প্রতিপালন করব। সময় সময় বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ধারা ও প্রকৃতির মানুষের উপর যেসব অত্যাচার সংগঠিত হয়েছে আমরা তার পূণরাবৃত্তির অবসান চাই।”
ঘোষণায় আরও বলা হয়, “বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বী থেকে শুরু করে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে আক্রমন ও ক্ষতিসাধন সহ যত সব নিপীড়ন হয়েছে ওগুলোর নিন্দা জানিয়ে প্রত্যেক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিশ্বাসী জনগণ ঘোষণা করছি যে আমাদের প্রতিবেশী দেশসমুহসহ সর্বত্র সাম্প্রদায়িক সম্পর্ককে অক্ষুন্ন রাখতে এবং যে কোন সহায়ক ভুমিকা পালন করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকব।
আমরা বৃটিশ-বাংলাদেশী জনগণ আরো ঘোষণা করছি যে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত নানা ধর্মের, নানা বর্ণের, নানা সংস্কৃতির, নানা জাতির মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বহু- সাংস্কৃতিক সমাজ ব্যবস্থায় আমরা একান্তভাবে বিশ্বাসী এবং এই ঐতিহ্যকে অটুট রাখতে তথা বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির মানুষের মধ্যে প্রীতি ও সুসম্পর্ক গঠনে সব সময় দৃষ্টি রাখব।
আমরা আরো ঘোষণা করছি যে আমাদের এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন অব্যাহত ভাবে চলমান থাকবে। পরস্পরের হাতে হাত ধরে সব ধরণের উগ্রবাদের বিরুদ্ধে আমরা সম্প্রীতির জয়গান গাইব।”
মুক্তিযোদ্ধা এবং সাংবাদিকতা ও সামাজিক অঙ্গনের সুপরিচিত ব্যক্তিবর্গ এমন একটি মহান অনুষ্ঠানকে সমর্থন জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন কনসার্টে। উপস্থিত সূধীজনদের মধ্যে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান, সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, ব্যারিষ্টার তানিয়া আমির, কলামিষ্ট সৈয়দ বদরুল আহসান, সাংবাদিক ও সত্যবাণী সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা, সাংবাদিক জুয়েল রাজ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম, সংস্কৃতিকর্মী মোস্তফা কামাল, অপু চৌধুরী, রুমি হক, সাংবাদিক বাতিরুল হক সর্দার, বিওন টিভি’র কর্ণধার রিয়াদ আহাদ ও সত্যবাণীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সৈয়দা ফেরদৌসি পাশাসহ অর্ধশতাধিক শিল্পী।
সম্প্রীতি কনসার্ট ইউকে মূলত একটি সাংস্কৃতিক ঐক্য। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শিল্পী, সাহিত্যিক, কলাকুশলী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক তথা সমগ্র জনগণের একটি সম্মিলিত, সৌহার্দ্যপূর্ণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উদ্যোগে গঠিত হয়েছে এই ‘সম্প্রতি’ সংগঠন। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বরে। শুরু থেকেই সংগঠনটি চেয়েছে অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক বার্তা সারা যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে দিতে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার পূর্বানাটের আমন্ত্রণে বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় সম্প্রীতি কনসার্ট ২০২৫। এবার এই কনসার্টে সঙ্গী হয়ে ‘পূর্বানাট’। পূর্বানাটও একই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একটি সংগঠন। আয়না আর্টসের কর্ণধার জেসমিন চৌধুরীর রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে নাটক ‘এ লাভ উইদাউট বর্ডার্স’। শেফিল্ডের ও বার্মিংহামের গানের দলের সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন যথাক্রমে লীনা পাল ও রোজী সরকার।
বাংলাদেশের হাজার বছরের লালিত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মিলিতভাবে একই মঞ্চে কাজ করে যাচ্ছে ‘সম্প্রীতি’। যে চেতনা ও বিশ্বাস থেকে ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ৩ লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগ এবং লাখো মুক্তিযোদ্ধার জীবনপণ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে, বাংলাদেশের সর্বত্র সেই সব অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের বাস্তবায়ন হলো ‘সম্প্রীতি’র প্রত্যাশা। ‘সম্প্রীতি’র দৃঢ় প্রত্যয়-চিন্তা ও চেতনায় মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি পরম আস্থা এবং মানব সত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধাবোধ ধারণ ও প্রতিপালন করা। সময় সময় বাংলাদেশে ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ধারা ও প্রকৃতির মানুষের উপর যেসব অত্যাচার সংগঠিত হয়েছে সংগঠনটি চায় তার অবসান। যার যার অবস্থান থেকে সমাজ ব্যবস্থায় আগামী প্রজন্মের কাছে একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক পৃথিবীর বার্তা পৌঁছে দিতে চায় সম্প্রীতি।