ডিসক্যালকুলিয়া: গণিতের সাথে লুকানো সংগ্রাম
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২:৩১:২৮ অপরাহ্ন
জামাল আহমেদ, PGCE
গণিত শিক্ষক ও SEND অ্যাম্বাসেডর
প্রায়ই গণিতকে সার্বজনীন ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এটি আমাদের চারপাশের বিশ্বকে বোঝার একটি মৌলিক মাধ্যম। যুক্তরাজ্যসহ সারা বিশ্বে এটি শিক্ষার একটি অন্যতম প্রধান বিষয়। এটি GCSE পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য একটি মূল যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, কিছু শিক্ষার্থীর জন্য সংখ্যা ও গণনা শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জিং নয়, বরং তা মারাত্মক হতাশা ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সংগ্রাম শুধুমাত্র গণিতের প্রতি অনাগ্রহ বা বিষয়টির জটিলতা থেকে আসে না; বরং এটি একটি নির্দিষ্ট শিখনভেদজনিত পার্থক্যের ফলে ঘটে, যা ডিসক্যালকুলিয়া নামে পরিচিত।
যুক্তরাজ্যের একটি মূলধারার স্কুলে গণিত শিক্ষক হিসেবে আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ শিক্ষাগত প্রয়োজনীয়তা ও অক্ষমতা—সেন্ড এর (Special Educational Needs and Disabilities—SEND) অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আমার দায়িত্ব থেকে, আমি ডিসক্যালকুলিয়ার মূল দিকগুলো তুলে ধরতে চাই। ডিসক্যালকুলিয়া হলো সেন্ডের একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র, যা অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিশেষ মনোযোগ ও গভীর বোঝাপড়া দাবি করে।
অনেকে ডিসক্যালকুলিয়াকে ডিসলেক্সিয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু এগুলো দুটি ভিন্ন ধরনের শেখার অসুবিধা, যা শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন শিক্ষাক্ষেত্রে ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। ডিসলেক্সিয়া মূলত সাক্ষরতার দক্ষতার উপর প্রভাব ফেলে। যেমন পড়া, লেখা এবং বানান, যা ব্যক্তির জন্য অক্ষর চিনতে, শব্দ বিশ্লেষণ করতে এবং লিখিত ভাষা প্রক্রিয়াকরণে সমস্যা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, ডিসক্যালকুলিয়া নির্দিষ্টভাবে গাণিতিক দক্ষতা সম্পর্কিত। এই অক্ষমতা সংখ্যাগুলি বুঝতে, গণনা করতে, সাংখ্যিক ধরন চিনতে এবং গাণিতিক ধারণা আয়ত্ত করতে অসুবিধা সৃষ্টি করে।
‘‘এই অক্ষমতা সংখ্যাগুলি বুঝতে, গণনা করতে,
সাংখ্যিক ধরন চিনতে এবং গাণিতিক ধারণা
আয়ত্ত করতে অসুবিধা সৃষ্টি করে।’’
ব্রিটিশ ডিসক্যালকুলিয়া অ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রায় ২৫% মানুষ গাণিতিক শিক্ষায় সমস্যার সম্মুখীন হন, যার মধ্যে প্রায় ৬% ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত। সাধারণ গাণিতিক শিক্ষার সমস্যার তুলনায়, ডিসক্যালকুলিয়া সংখ্যাগুলি ও পরিমাণ নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে চরম অসুবিধার সৃষ্টি করে। এটি আজীবন চলমান একটি সমস্যা, যা ব্যক্তির বয়স, অভিজ্ঞতা এবং সুযোগের উপর নির্ভর করে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়।
একজন গণিত শিক্ষক হিসেবে, আমি প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে পর্যবেক্ষণ করি যে ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন উপসর্গ প্রদর্শন করে। এর মধ্যে রয়েছে সংখ্যা ও তাদের মান চিহ্নিত করতে অসুবিধা, যোগ, বিয়োগ, গুণ এবং ভাগের মতো মৌলিক গাণিতিক ক্রিয়াগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যা, সময়, পরিমাপ এবং অর্থের মান বোঝার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ, নির্দিষ্ট বয়সের পরও আঙুল গুনে গণনার প্রতি নির্ভরশীলতা, গাণিতিক ধরণ ও ধারাবাহিকতা চিনতে অক্ষমতা এবং গাণিতিক কাজের ক্ষেত্রে উদ্বেগ ও হতাশার অনুভূতি।
শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং প্রাত্যাহিক জীবনে প্রভাব
ডিসক্যালকুলিয়া শুধু শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকে না। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে এ অক্ষমতা। অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেন না ব্যাপারটি। গাণিতিক দক্ষতা আর্থিক ব্যবস্থাপনা, সময় বোঝা, রেসিপি অনুসরণ এবং মানচিত্র বুঝে নিয়ে পথ চলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীরা প্রায়ই আত্মবিশ্বাসের অভাব ও উদ্বেগের শিকার হন, বিশেষ করে যখন তাদের সমস্যাগুলো আলস্য বা প্রচেষ্টার অভাব হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়।
‘‘সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত
শিক্ষার্থীরাও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে, গাণিতিক দক্ষতা
বাড়াতে এবং একাডেমিক ও বাস্তব জীবনে সাফল্য অর্জন
করতে সক্ষম হবে।’’
যুক্তরাজ্যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের গাণিতিক ধারণা ভালোভাবে বোঝাতে অতিরিক্ত সহায়তা ও বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করে। ডিসক্যালকুলিয়া বিশেষ শিক্ষাগত চাহিদা ও অক্ষমতা (SEND) এর আওতাভুক্ত এবং এটি সংখ্যা চিনতে, গাণিতিক ক্রিয়াগুলো বুঝতে এবং সংখ্যার মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণে সমস্যা সৃষ্টি করে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষকরা ধাপে ধাপে নির্দেশনা, চিত্রভিত্তিক সহায়ক উপকরণ, স্পষ্ট ও বারবার ব্যাখ্যা এবং হাতে-কলমে শেখানোর কৌশল ব্যবহার করেন। এতে শিক্ষার্থীদের শেখার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ হয়।
এছাড়া, শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ ও হতাশা কমানোর জন্য গণিত শিক্ষকরা বাস্তব জীবনের উদাহরণের মাধ্যমে গাণিতিক ধারণাগুলো উপস্থাপন করেন। বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি, যেমন মৌখিক ব্যাখ্যা, গ্রাফিক সংগঠক, এবং নির্দেশিত সহায়তা ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গাণিতিক সমস্যার সমাধান আরও সহজে করতে পারে। ছোট ছোট দলে শেখার সুযোগ, অতিরিক্ত সময় সুবিধা, এবং ডিজিটাল সরঞ্জামের ব্যবহার শিক্ষাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর করে তোলে। মূল লক্ষ্য হলো প্রতিটি শিক্ষার্থীর নিজস্ব শেখার গতিকে সমর্থন করা এবং গণিতের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা।
সচেতনতা বৃদ্ধি ও বোঝাপড়ার উন্নতি
যদিও ডিসক্যালকুলিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ, এটি এখনো ব্যাপকভাবে অপরিচিত এবং অনেক শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়। এই সমস্যা সমাধানে অভিভাবক, স্কুল, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের একসঙ্গে কাজ করে ডিসক্যালকুলিয়ার লক্ষণ চিহ্নিত করা ও কার্যকর শিক্ষার কৌশল বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। যথাযথ সহায়তার মাধ্যমে ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক পারফরম্যান্সের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে পারে।
ডিসক্যালকুলিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের সুযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব যে গাণিতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে না। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহায়ক শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে, আমরা এই শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এবং তাদের সক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারি, যা শেষ পর্যন্ত তাদের শিক্ষাগত ও পেশাগত ভবিষ্যতের জন্য উপকারী হবে। গণিত শিক্ষা শুধুমাত্র যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ শেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি সবার জন্য সহজবোধ্য ও প্রবেশযোগ্য হওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা দৈনন্দিন জীবনে এবং এর বাইরেও সাফল্য অর্জন করতে পারে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীরাও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে, গাণিতিক দক্ষতা বাড়াতে এবং একাডেমিক ও বাস্তব জীবনে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে।