হাবিপ্রবি কান্ট্রি ট্যুর: দুর্নীতি, অনিয়ম ও প্রতারণার শিকার শিক্ষার্থীরা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৩০:০৩ অপরাহ্ন
মুরাদ হোসেন, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর: দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহীন (ছদ্দনাম) । সম্প্রতি তাঁদের ব্যাচের কাঙ্খিত কান্ট্রিট্যুর হবে । ১৫ দিনের ট্যুর হবে যেখানে যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ বাবদ বিশ হাজার টাকা খরচ হবে । এই ট্যুরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ থাকে । আর্থিক বরাদ্দ থাকার পরও অতিরিক্ত দশ থেকে তেরো হাজার টাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেতে পারছে না শাহিনের মতোন শতাধিক মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, “অর্থাভাবে ট্যুরে অংশগ্রহণ করতে না পারার পর আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা হওয়ার কথা ছিল । তা আমাদের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সিগনেচার নিয়ে উত্তোলন করে ট্যুরের অন্যান্য খরচে যোগ করা হচ্ছে ।
ট্যুরে না যাওয়া শিক্ষার্থীদের টাকা উত্তোলনের বিষয়ে হিসাব শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. মো এরফান আলী খন্দকার বলেন, ” যখন ডিপার্টমেন্ট এবং অনুষদ থেকে অনুমোদন পাওয়া যায়, তখন আমরা এখানে অনুমোদন দিয়ে দেই । আমরা বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নেবো না, কারণ সেটা আমাদের কাজ নয় এবং আমাদের এখতিয়ারও নেই ।”
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে যায়, কান্ট্রি ট্যুর মূলত একটি নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক কোর্সের অংশ হিসেবে গবেষণাগার, শিল্প কলকারখানা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ভ্রমণ। এর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন এবং তাদের শিক্ষাগত মান যাচাই করা। তবে বর্তমানে এই উদ্দেশ্য থেকে কিছুটা সরে গিয়ে কান্ট্রি ট্যুর এক প্রকার আনন্দ ভ্রমণে পরিণত হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা মূলত অবসর সময় কাটানোর এবং বিনোদনের জন্য বের হয় । এতে শিক্ষা ও গবেষণার যে মূল লক্ষ্য ছিল, তা অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হয়ে যাচ্ছে।
এই কান্ট্রি ট্যুর আয়োজনকে কেন্দ্র করে এজেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই শিক্ষার্থীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। তারা ব্যাচের দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থীদের ১৫-২০ হাজার টাকার কমিশন দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ট্যুরের আয়োজনে যুক্ত করে, তবে বিনিময়ে সার্ভিস থাকে কম।যেকারনে বাকি শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করলে এজেন্সি ওই কমিশনের কথা তুলে ধরে। এই ধরনের প্রতারণা প্রতি বছর হাবিপ্রবির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ঘটে, ফলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ট্যুর প্যাকেজের আকর্ষণীয় অফারগুলো প্রায়ই বাস্তবসম্মত না হওয়ায়, এজেন্সিগুলোর প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিশ ব্যাচের শিক্ষার্থী রাহিম বলেন,” হাবিপ্রবির ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে ট্যুর ছিল আমাদের, এশিয়ান টুরিজম এজেন্সির কারণে । আগে থেকে পরিকল্পনা করা জায়গাগুলো, যেমন মাধবকুণ্ড, শৈলপ্রপাত, সাজেক, ইত্যাদিতে না নিয়ে গিয়ে সময় নষ্ট করেছে। পরে রাঙামাটি থেকে সাজেকে নিয়ে গেলেও এসব জায়গা মিস হয়। এজেন্সি আমাদের টাইম সেন্সের অজুহাত দেয়। পুরো ট্যুরে আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি ।”
কৃষি অনুষদের আরেক শিক্ষার্থী তানবীর ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, “আমাদের কান্ট্রিট্যুরের এজেন্সি ছিল ট্রাভেললিঙ্ক হলিডে । ১৫,৫০০/- টাকা দিয়ে ৮৪ জনের ১২ দিনের ট্যুরের চুক্তি হয়েছিল । তবে, ট্যুরে সিলেটে নৌকা ভাড়া করা হয়নি, সাজেকে দেরি হয়েছে, সেন্টমার্টিনের টিকেট ছিল ভুয়া, আর এজেন্সির লোকজন আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। আমরা শেষ পর্যন্ত সেন্টমার্টিনের জন্য নিজেরাই ব্যবস্থা করি। ট্যুরে সঠিক সেবা না পাওয়ার কারণে আমরা আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি ।”
বিভিন্ন বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী জিও ট্রিপস এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে জানায় , জিও ট্রিপস কিছু শিক্ষার্থীদের মদ সরবরাহ করছে । এছাড়া যেসব স্থানে ট্যুরের পরিকল্পনা ছিল, সেসব স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়নি । শিক্ষার্থীরা এই বিষয়ে অসন্তুষ্ট এবং যথাযথ পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে ।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে একাধিক ট্যুর এজেন্সির সাথে কথা বলে জানা যায়, কান্ট্রি ট্যুরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাঁদেরও অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে ট্যুরিসেটরা ট্রাভেল হোম (পূর্ব নাম ট্রাভেললিঙ্ক হলিডে) এজেন্সির প্রতিনিধি মোঃ ইকবাল শাহেদ খান বাবু বলেন,”শিক্ষকদের অসহযোগিতার কারণে একটি সুন্দর ট্যুরের পরিণতি অত্যন্ত দুঃখজনক হয়েছে । এতে আমার ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে । কিছু শিক্ষক তাদের কাঙ্ক্ষিত ট্যুর এজেন্সি নির্বাচন করতে না পেরে আমাকে মানসিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে । এর ফলস্বরূপ, অনেকেই আমাকে চিটার ও বাটপার বলছে, অথচ প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করা হচ্ছে না । আমি সকল প্রমাণ ও ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করেছি এবং আমি অনুরোধ করছি, এই পরিস্থিতির সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক । শিক্ষকদের ন্যাক্কারজনক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি ।”
জিও ট্রিপস এজেন্সি প্রতিনিধি মুহাইমিনুর বলেন, “আমরা সবসময় মাদক দ্রব্য নেশা পানির বিপক্ষে। এটা আমাদের ট্যুর এজেন্সির সাথে যায় না তবে এটা সত্য দেখা যাচ্ছে ট্যুর টা সুন্দর ভাবে শেষ করতে একদল এসব শিক্ষার্থী অনৈতিক দাবি দাওয়া করে যেটা না দিলে তারা ট্যুর পণ্ড করে দেওয়া, অযৌক্তিক অভিযোগ ছাড়াও ট্যুর এজেন্সির নামে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে রেপুটেশন নষ্ট করার হুমকি দেয়। আমরা অনেক দিন থেকেই এই ক্যাম্পাসে ট্যুর করাচ্ছি এটা দেখেই আসছি যারাই অনৈতিক সুবিধা দেয় না, তাদের নামে বিভিন্ন অযৌক্তিক অভিযোগ, ট্যুরে ঝামেলাসহ এজেন্সির লোকদের হয়রানি করা হয়”।
একাধিক এজেন্সির প্রতিনিধিরা বলেন, এতদিন ধরে শিক্ষকদের অতিরিক্ত দাবি এবং ফ্লাইট টিকিট, হোটেল সুবিধা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে । এতে শুধু শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, বরং আমাদেরও ক্ষতি হচ্ছে । যদি ট্যুরে দায়িত্বে থাকা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত দাবি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়, তবে তা সরাসরি ট্যুরের খরচ বাড়িয়ে দেয় এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এজেন্সিগুলোর মতে, যতদিন পর্যন্ত এই ধরনের অস্বচ্ছ পরিস্থিতি থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা সঠিক সেবা দিতে পারবো না । সঠিক সমাধান পেতে হলে, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং ট্যুর এজেন্সি তিন পক্ষের মধ্যে সুষ্ঠু আলোচনা এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। বিডিং পদ্ধতির মাধ্যমে টেন্ডার চালু করলে, সকলের দাবি পর্যালোচনা করা যাবে এবং একটি স্পষ্ট ও ন্যায্য সমাধান বের করা সম্ভব হবে ।
এ বিষয়ে ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক ড. মো. এমদাদুল হাসান বলেন, “এ ধরনের বিষয়গুলো আমার কাছে আসে, তবে এগুলোর দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব ট্যুর কমিটির । আমার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কান্ট্রি ট্যুরের মূল সমস্যা হচ্ছে ট্যুর এজেন্সিগুলো। কান্ট্রি ট্যুরের সিস্টেমটি সংস্কারের প্রয়োজন, এবং আমি ভবিষ্যতে এটি সংস্কারের পরিকল্পনা করছি।”
কান্ট্রি ট্যুরের বাজেট বরাদ্দ নিয়ে ইউজিসি কর্তৃক অডিট আপত্তি আসার পর ট্রেজারার ও রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর কবির এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন , “শিক্ষার্থীদের দিক বিবেচনা করে , আমরা ইউজিসির সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের জন্য এই ট্যুরের বরাদ্দ বজায় রাখতে চাই । আমরা চাই না শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের যে সুবিধা রয়েছে, তা বন্ধ হয়ে যাক। এজন্য ইউজিসিকে আর্থিক ব্যাখ্যা প্রদান করে তাঁদের সম্মতি অর্জনের চেষ্টা করছি।”