আসন্ন নির্বাচনে আ. লীগের অংশ নেওয়ার সুযোগ কতটুকু?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮:৩০:৫৪ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক:: নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে নানামুখী আলোচনার মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দেড় বছরের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি সম্ভাব্য সময়সীমার কথা জানিয়েছেন। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে গণঅভ্যত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা আছে, কি নেই সম্প্রতি এ নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্য ঘিরে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রংপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি কোনো বাধা দেখছেন না।
তার এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে ওই রাতেই বিবৃতি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে শুক্রবার রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার তার বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কোনো দলকে বাদ দেওয়া কিংবা ভোটে সুযোগ করে দেওয়ার কোনো বিষয়, এটা আমাদের প্রস্তাবের বিবেচনার মধ্যেও নাই।’
শনিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগের বিচার হতে হবে তার আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের প্রশ্নই অপ্রাসঙ্গিক।
’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো একই অবস্থান বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আরেকটি প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটিরও।
নির্বাচন সংস্কার কমিশন মনে করছে, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের যে আইন রয়েছে তাতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না হলে কিংবা বিচারিক প্রক্রিয়ায় দলটি দোষী সাব্যস্ত না হলে তাদের ভোটে অংশগ্রহণের একটি সুযোগ রয়েছে।
গত জুলাই অগাস্টে ছাত্রদের আন্দোলনের সময় গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
কোনো দলের অপরাধ এখনো আমরা তদন্ত করছি না। ভবিষ্যতে আমাদের কাছে যদি মনে হয় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত সেটা তখন বলা যাবে।’
এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার কতটা সুযোগ রয়েছে সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে।
আগে বিচার, পরে অন্য প্রশ্ন
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি তাদের শরীক ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে গণহত্যার বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। গণহত্যার বিভিন্ন মামলায় তাদের হাজির করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেকোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিপক্ষে অবস্থান করে। নির্বাচনসহ যে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের রক্তের অবমূল্যায়ন হবে।’
সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগ গণহত্যায় জড়িত। তাদের সাথে ১৪ দলও একই অপরাধে জড়িত। আগে গণহত্যার বিচার হবে, তারপর অন্য প্রশ্ন।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আরেকটি প্লাটফরম জাতীয় নাগরিক কমিটিও এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিচার ও দল হিসেবে সংগঠনের বিচার নিয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে জনমত তৈরি করছে। এই সংগঠনটি মনে করে এই মুহূর্তে যদি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার না হয় তাহলে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
দলটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। হাজার হাজার ছাত্রদের আহত করা হয়েছে। যারা খুনি তাদের বিচারের আগেই যদি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যান, তাহলে পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে।’
নির্বাচনী আইন কী বলছে?
শুক্রবার রাতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে যে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি আইনে এরই মধ্যে অনেক মামলা রজু হয়েছে শেখ হাসিনাসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের নির্বাচন কার্যক্রম নির্ভর করবে এসব মামলা সুরাহার ওপর।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইনে কেউ দণ্ডিত হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে বলা আছে, কেউ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘কোনো দল আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে কিংবা নির্বাহী আদেশে কোনো দল নিষিদ্ধ হলে নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা যে কোনো দলই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।’
তিনি জানান, এর বাইরেও কোনো দল পরপর দুই বার নির্বাচনে অংশ না নিলে কিংবা দলীয় গঠনতন্ত্রে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু থাকলে সে দলের নিবন্ধন বাতিল করার সুযোগ নির্বাচন কমিশনের আছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচনি ও ফৌজদারি অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে দণ্ডিত ব্যক্তি একসময় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ফিরে পান। কিন্তু আইসিটি আইনে কেউ অপরাধী সাব্যস্ত হলে তিনি আজীবনের জন্যই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, তারা যে সংস্কার প্রস্তাব আনছেন সেখানে আইসিটি আইনের এই ধারা বাদ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
ট্রাইব্যুনাল ও আওয়ামী লীগের বিচার
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে গত সাড়ে তিন মাসে প্রায় পৌনে দুইশো অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী, ১৪ দলের শীর্ষ নেতা, সাবেক ও বর্তমান আমলাসহ অনেককেই আসামি করা হয়েছে।
এছাড়াও এই ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ১৫ বছরের বেশি শাসনামলে গুম–খুনের বিভিন্ন ঘটনায় বেশ কিছু অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।
এরই মধ্যে এইসব ঘটনায় তদন্ত কাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হওয়ার পর যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ফরমাল চার্জ জমা দিবো তারপর আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এটা কতদিনে শুরু বা শেষ হবে সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না।’
তবে প্রাথমিকভাবে যে বিচারকার্য শুরু হয়েছে সেখানে আগে ব্যক্তির বিচার কাজ হবে। আওয়ামী লীগ কিংবা কোনো দলের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
তবে আওয়ামী লীগের বিচার ও নির্বাচন ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘এটা যখন আমাদের জুরিশডিকশনের মধ্যে পড়বে তখনই আমরা এ ব্যাপারে মন্তব্য করবো। আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিল, অভ্যুত্থানের মুখে তাদের পালিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ বা সাধারণ মানুষ নির্ধারণ করবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিবে কি, নিবে না।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা নির্বাচনে আজীবন নিষিদ্ধ হতে পারেন
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা তুঙ্গে। এর মধ্যে গত শুক্রবার রাতে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠান। সেখানে ইঙ্গিত মিলেছে, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রথম শ্রেণির নেতারা নির্বাচনে আজীবন নিষিদ্ধ হতে পারেন। ভোটার তালিকা থেকেও বাদ পড়তে পারেন তাঁরা। একই পরিণতি ঘটতে পারে আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের ক্ষেত্রেও
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ব্যাপক প্রাণহানি, অনেকের পঙ্গুত্ব, দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে গুমসহ নানা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এবং সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান থেকেও আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্ভাব্য এই পরিণতির পক্ষে যুক্তি আছে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না—প্রশ্নে গত বৃহস্পতিবার রংপুরে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, ‘তাদের জন্য কোনো বাধা সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি দেখছি না।’ পরে ওই দিন রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যম তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন। এতে তিনি বলেন, ‘এটি কারো অজানা নয় যে আইসিটি (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) আইনে এরই মধ্যে অনেক মামলা রজু হয়েছে শেখ হাসিনাসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। হত্যা মামলাও করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচন কার্যক্রম নির্ভর করবে এসব মামলা সুরাহার ওপর।’
নির্বাচন কর্মকর্তারাও বলছেন, ‘আইসিটি আইনে কারো সাজা হলে তিনি আজীবন নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। ভোটার তালিকা থেকেও বাদ পড়বেন। আইসিটি প্রসিকিউটরদের বক্তব্য, নিউক্লিয়াস এবং সুপ্রিম কমান্ডারদের ব্যাপারে আমরা এখন উদ্যোগী, মনোযোগী। তাঁদের বিচারটাই আগে হবে।’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এর ১২ অনুচ্ছেদে যেসব কারণে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে না, তা বলা আছে। এই অনুচ্ছেদের (ণ) উপ-অনুচ্ছেদে বলা আছে, কেউ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের অধীনে কোনো অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হলে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ নির্বাচনের যোগ্যতা-অযোগ্যতা সম্পর্কে এই অনুচ্ছেদের (ঙ) উপ-অনুচ্ছেদে একই কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া ভোটার তালিকা আইন, ১৩(ঘ) ধারায় ভোটার তালিকা থেকে নাম কর্তন সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেউ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের অধীনে কোনো অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হলে ভোটার তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়বে। আবার ভোটার না হলে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। আরও যেসব কারণে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে না, তার মধ্যে রয়েছে নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে কেউ অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে থাকলে তাঁর মুক্তিলাভের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদেও এটি উল্লেখ আছে। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২(ঘ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ৭৩, ৭৪, ৭৮, ৭৯, ৮০, ৮১, ৮২, ৮৩, ৮৪ ও ৮৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নির্বাচনী অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে থাকলে তাঁর মুক্তিলাভের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে।
নির্বাচন কর্মকর্তাদের মতে, নির্বাচনী ও ফৌজদারি অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে ওই দণ্ডিত ব্যক্তি একসময় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ফিরে পান। কিন্তু আইসিটি আইনে কেউ অপরাধী সাব্যস্ত হলে ‘সময় অতিবাহিত’ হওয়ার সুযোগ তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য জানান, তাঁরা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-এর ১২(ণ) অনুচ্ছেদটি রেখে দেওয়ার পক্ষে। এ আইনেই আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা নির্বাচনে আজীবন অযোগ্য হতে পারেন। কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা হয়েছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এই কমিশন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষের দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করলেও আওয়ামী লীগ ও এর সঙ্গে জোটভুক্ত দলগুলোকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানায়নি। অন্য সংস্কার কমিশনগুলোও একই নীতি গ্রহণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপের ডাক পাননি আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের নেতারা। অবশ্য এই সব নেতার মধ্যে অনেকেই পলাতক বা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে।
জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ছাড়াও দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে গুম, পিলখানা ট্র্যাজেডিসহ নানা ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ জমা হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অনেক নেতা, সাবেক পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ গতকাল শুক্রবার সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৬৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে গুমের অভিযোগ ৩১টি। গত ১৭ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেপ্তার সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ১২ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, শেখ হাসিনার দুই উপদেষ্টাসহ ১৬ জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ওই দিন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আল নোমান সাংবাদিকদের জানান, জুলাই-আগস্টের গণহত্যার অভিযোগে ৪৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত এক মাসের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে।’
ট্রাইব্যুনালে জমা অভিযোগের তদন্ত নিয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তদন্ত কাজ কত দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। এত বড় গ্রেভিটির (অপরাধের ধরন) মামলার প্রপার তদন্ত, প্রপার রিপোর্ট সাবমিট করার জন্য অনেক সময় প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে আমরা কোর্টের কাছ থেকে সময় নিচ্ছি, যাতে আমাদের প্রগ্রেসটা (অগ্রগতি) যথেষ্ট হয়েছে কি না, তা আদালতকে দেখাতে পারি।’
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা আশা করছি এর মধ্যে (আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে) তদন্ত অনেক দূর এগিয়ে যাবে। খুব সহসাই হয়তো রিপোর্টগুলো সম্পন্ন করতে পারব তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় (থানায় বা আদালতে) মামলা হয়েছে। সেসব মামলার তদন্ত চলতে থাকবে। উপযুক্ত সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা ট্রাইব্যুনালে রেফার (স্থানান্তর) করা হবে।’
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনাল বেছে বেছে ওয়ারেন্ট (গ্রেপ্তারি পরোয়ানা) দিচ্ছে। যে হারে (জুলাই-আগস্ট গণ-আন্দোলনে) গণহত্যা হয়েছে, সারা বাংলাদেশে যে হারে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, আমরা যদি সব অপরাধীকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসি, তার সংখ্যা হবে হাজার হাজার। যেটি এই মুহূর্তে প্র্যাগমেটিক (বাস্তবসম্মত) না। আমরা যদি হাজার হাজার আসামিকে (অভিযোগের) আওতাভুক্ত করি, তাহলে যাদের নেতৃত্বে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, তাদের বিচারকার্য বিঘ্নিত হবে। সে কারণে আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ (গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ক্ষেত্রে) করেছি। যারা সবচেয়ে বড় অপরাধী, যারা নিউক্লিয়াস, তাদেরটা (অভিযোগের বিচার) আগে আসবে। অন্যদেরটা ক্রমান্ব্বয়ে আনতে হবে। নিউক্লিয়াস এবং সুপ্রিম কমান্ডারদের ব্যাপারে আমরা এখন উদ্যোগী, মনোযোগী।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা জানান, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একাধিক গণহত্যার জন্য দায়ী। এ ছাড়া গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বিভিন্ন মানবাধিকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ ১৬ বছর ধরে জড়িত ছিল। সর্বশেষ জুলাই গণহত্যায় প্রায় দুই হাজার শহীদের প্রাণ এবং ৩০ হাজারের বেশি মানুষের অঙ্গহানি করেছে দলটি। আওয়ামী লীগ বিগত তিনটি নির্বাচনকে অবৈধ উপায়ে নিজেদের কুক্ষিগত করেছে। যে দলটি বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া জন-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধাচরণ।
সূত্র: বিবিসি ও অন্যান্য