বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র দাসের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫:৫৪:২৬ অপরাহ্ন
সালেহ আহমদ (স’লিপক): হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার মুক্তাহার গ্রামের কৃতিপুরুষ, একাত্তরের রণাঙ্গণে ৫ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, খ্যাতিমান শিক্ষক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্র চন্দ্র দাসের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৭১-এ বিজয় অর্জনকারী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ২৯ ডিসেম্বর তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি ও সদগতি কামনায় পরলৌকিক ক্রিয়াদি তথা একোদ্দিষ্ঠ শ্রাদ্ধ মুক্তাহার গ্রামের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে।
পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে রবীন্দ্র চন্দ্র দাস বাল্যকাল থেকেই ছিলেন সংস্কৃতমনা। ছাত্রজীবনে তিনি যাত্রাদলে অভিনয় ও গানের ভীষণ অনুরাগী ছিলেন। কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স ছাড়াই ছাত্রজীবনে বাউলসংগীত ও লোকসংগীতে পারদর্শিতার পাশাপাশি অভিনয়েও সমান পারঙ্গমনতা অর্জন করেন। তাছাড়া ফুটবল, হা-ডুডু, দৌড়, সাঁতার, বক্তৃতা সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় হবিগঞ্জ মহকুমা সহ বৃহত্তর সিলেটের মধ্যেও বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি।
রবীন্দ্র চন্দ্র দাস ছাত্র হিসেবে যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র সংসদ রাজনীতিতেও ছিলেন সক্রিয়। অংশগ্রহণ করেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচীতে। তখন সময়টা অর্থাৎ ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালটা ছিল উত্তাল। এই সময়ে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কর্মকান্ডে হবিগঞ্জ আসলে, তাঁদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগও হয় তাঁর। মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর (হবিগঞ্জের) রক্তে আগুনলাগা জ্বালাময়ী ভাষণে উদ্ভুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকা মুক্ত করার সংগ্রামে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশ জুড়ে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়, তখন যুবক রবীন্দ্রও স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যুদ্ধে যোগদানের প্রত্যয় নিয়ে বাড়ী ফিরেন। নবীগঞ্জে এসে মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি পুরুষ জননেতা শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধু বাবু) এর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করেন।
স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে তিনি পরিবার পরিজন সহ ভারত গমন করেন। মৈলাম শরনার্থী ক্যাম্পে পরিবার-পরিজনদের রেখে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্পে উপস্থিত হন। ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল মীর শওকত আলী (পরবর্তীতে লে. জেনারেল) তাঁকে রিক্রুট করেন। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ৫নং সেক্টরের ৩০ জনের চৌকুস ও শিক্ষিত একটি যুবকদের নিয়ে (WAR Trained Intelligence & Security Branch) স্পেশাল ব্যাচ-২ গঠন করলে, মুক্তিযুদ্ধের যুব শিবিরের প্রশাসক ভারতীয় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব:) এন সি বসাক মহোদয়ের নির্দেশে ৩০ জনের ঐ দলকে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জোয়াইন এলাকার ইস্টার্ণ কমান্ড ওয়ান (ইকো অওয়ান) এ পাঠানো হয়। এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রবীন্দ্র চন্দ্র দাস। ইকোওয়ান-এ ইন্টেলিজেন্ট ব্রাঞ্চের কার্যক্রমের উপর (WAR Trained Intelligence & Security Branch) ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ডিংরাই ইয়ুথ ক্যাম্প প্রশাসক ফ্লাইট ল্যাফটেন্যান্ট (অব:) নরেন্দ্র চন্দ্র বসাকের (এন সি বসাক) নির্দেশে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের টেকারঘাট সাব-সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন মোসলেম উদ্দিন ওরফে দীন মোহাম্মদ এর অধীনে মুক্তিযুদ্ধের স্বশস্ত্র পর্বে অংশগ্রহণ করেন। একটা সময় ক্যাপ্টেন দীন মোহাম্মদের সাথে তাঁর সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোমালিন্য দেখা দিলে তিনি বালাট সাব-সেক্টরে চলে আসেন। বালাট সাব-সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন এম.এ মোত্তাল্লিব এর অধিনে তিনি ভাতেরটেক, পলাশ, আমবাড়ি, বৈষেরভের, চিনাকান্দি, গৌরারং, টেংরাটিলা, ডলুয়া প্রভৃতি স্থানে সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি চাকুরী প্রতিযোগিতায় নেমেই আশাতীত সুযোগ পান একই সাথে তিনটি পদে উত্তীর্ণ হয়ে। পদ তিনটি হলো পুলিশ বিভাগে সাব-ইন্সপেক্টর, চা বাগানের টিলা বাবু এবং প্রাইমারী স্কুলের সহকারী শিক্ষক। তাঁর পিতার নির্দেশে ও শিক্ষা বিস্তারের প্রতি গভীর আগ্রহের কারণে শিক্ষকতাকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। একটা সময় শিক্ষক হিসেবে তিনি খ্যাতি কীর্তি অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে সম্মাননা পান।
তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধাদের দাবী আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। রবীন্দ্র চন্দ্র দাস ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানবতাবোধ সম্পন্ন একজন দেশপ্রমিক তথা আদর্শবান ব্যক্তিত্ব। আজীবন অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং আলোকিত জাতি গঠনে তিনি কাজ করে গেছেন। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার মুক্তাহার নিজ গ্রামে তাঁর নামানুসারে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রবীন্দ্র চন্দ্র দাস গ্রন্থাগার’ প্রতিষ্ঠিত করা হয়।