শেখ হাসিনার বক্তব্য ‘ফাঁকা আওয়াজ’ নাকি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪:২১:০৬ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: তীব্র গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার কিছু ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে তাকে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতে শোনা গেছে। তবে সেগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়ার প্রায় চার মাস পর বিদেশে বিভিন্ন স্থানে জনসম্মুখে বক্তব্য দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। গত সপ্তাহে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন এবং আগামী ৮ ডিসেম্বর তিনি লন্ডনে আরও একটি অনুষ্ঠানে টেলিফোনে অংশ নেবেন। বিবিসি বাংলাকে এটি নিশ্চিত করেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
শেখ হাসিনার বক্তব্যকে বিদ্বেষমূলক বলছে সরকার। তার বক্তব্য গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ও এক্সে প্রচার না করতে আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে এসব মাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্য অতিদ্রুত সরাতেও বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপক্ষের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে এ আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অতিদ্রুত এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন। এসব বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনা ‘রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন’ বলে মনে করছে বিএনপি। তার এ বক্তব্যের অর্থ কি এমন যে শেখ হাসিনা আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন?
শেখ হাসিনা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া প্রসঙ্গে
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে যেধরনের টানাপোড়েনমূলক সম্পর্ক চলছে, এর মাঝে হঠাৎ করে শেখ হাসিনার সরাসরি বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টিতে অনেকেই মনে করছেন যে শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ বিরতি ভেঙে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছে।
যদিও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ বরাবরই রাজনীতিতে আছে। তার নতুন করে ফিরে আসার তো কিছু নাই।’
নিউ ইয়র্কে শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে যেসব দাবি করেছেন, সেসবের অন্যতম ছিল– বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চলছে, এবং তিনি ও তার বোন শেখ রেহানাকে খুন করার চক্রান্ত করা হয়েছিল ইত্যাদি।
‘শেখ হাসিনা যা যা বলছেন, তা দেশের স্বার্থে বলছেন’ উল্লেখ করে খালিদ মাহমুদ আরও বলেন, ‘দেশ এখন দুর্বৃত্তদের হাতে চলে গেছে। দেশকে, দেশের মানুষকে, দেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা আওয়ামী লীগের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ আওয়ামী লীগ এই দেশের সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত।’
এদিকে বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সব ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। যদিও চলতি বছরের আগস্টে সেই আদেশ প্রত্যাহার করেছে হাইকোর্ট।
যদিও শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের বিষয়ে আদেশের সমালোচনা করে খালিদ মাহমুদ বলেছেন, এটি ‘বাক স্বাধীনতা হরণ’।
তিনি বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে আসছে।
শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে সবরকম প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার দাবি করা হলেও লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করছেন, ‘শেখ হাসিনা বা তার দলের লোকেরা কে কী করছেন – না করছেন, এই পুরো বিষয়টা একটি খেলার অংশ।’
‘এগুলো সব ফাঁকা আওয়াজ’ বলছিলেন তিনি।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ শেখ হাসিনার বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘শেখ হাসিনা যেখানে যা-ই বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বিদ্বেষমূলক কথাবার্তাই বলছেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে, উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছেন।’
আহমেদ মনে করেন, শেখ হাসিনার এগুলোর মাধ্যমে রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এটিকে আমরা রাজনীতি বলতে পারি না।
শেখ হাসিনার ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আদালতের আদেশকে ‘সঠিক’ এবং ‘সমর্থনযোগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেন আহমেদ।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, সর্বশেষ জুলাই-অগাস্টে তিনি দেশজুড়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন। এইরকম হত্যাকাণ্ড চালিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে তার আর রাজনৈতিক কাজ করার কোনও অধিকারের নৈতিক জায়গা থাকে না।’
তবে ওই ঘটনার পর শেখ হাসিনা ও তার দল এখন যা-ই করুক, ‘কথা বলে আর বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না তারা। কারণ তার সমস্ত জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।’
শেখ হাসিনা ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার জন্য উসকানি প্রদান করছেন’ বলে মনে করেন সাকি।
শেখ হাসিনা ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক
শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তার যেসব বক্তব্য সামনে এসেছে, সেসব সম্বন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিনের মাথায়ই ভারতীয় হাইকমিশনারকে বলেছেন, শেখ হাসিনা যেন ভারতে বসে রাজনৈতিক বক্তব্য না দেন।
প্রাথমিকভাবে ভারতে বসে শেখ হাসিনাকে সরাসরি কোনো বক্তব্য দিতে না দেখা গেলেও, তিনি পর্যায়ক্রমে দুটি লিখিত বিবৃতি দেন। এবং সর্বশেষ নিউইয়র্কের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং দিতে যাচ্ছেন, এসব নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে তৌহিদ হোসেনসহ সরকারের একাধিক দায়িত্বপ্রাপ্ত’র সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি বাংলা। তবে তাদের কারও সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ‘বিদেশে বসে কিছু কিছু লোক নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে বাংলাদেশের বিষয়ে এসব প্রচারণা চালাচ্ছেন। পুরোটাই ভারতের তৈরি পাণ্ডুলিপি বা চিত্রনাট্য।’
শেখ হাসিনা সেই চিত্রনাট্যের কেবলই একটি অংশ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সেই হিসাবে তিনি এখানে আছেন। ভারতের কনসার্ন হচ্ছে, মিলিটারি অ্যান্ড ইকোনমিক যে সুবিধা দিয়ে আসছিলেন, সেই পরিস্থিতি তো পরিবর্তন হয়ে গেছে। সুতরাং, একটি রাজ্য হারানোর শোক তো ভারত করবেই।’
কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্য যদি কোনো চিত্রনাট্যের অংশ হয়ও, তা থামাতে বাংলাদেশের কী করার আছে এবং দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কি?
জানতে চাইলে আহমদ বলেন, ‘এক্সিস্টিং পলটিক্যাল পার্টির জন্য এটি চ্যালেঞ্জ হবে তখন, যখন তারা কাউন্টার করতে না পারে। এটি নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর সক্ষমতার ওপরে।’
তিনি আরও বলেন, তারা যদি সক্ষম হতে পারে, তাহলে তারা কাউন্টার প্রোপাগান্ডা দিয়ে ওটা সামাল দেবে। তাদের যদি সেই সক্ষমতা না থাকে, তাহলে তারা কিসের রাজনীতি করে? আমার কথা হল, আওয়ামী লীগ বিরোধী যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদেরও নাকি বিদেশে শাখা আছে। এখন তারা কী কাউন্টার প্রোপ্যাগান্ডা করছে, তা আমরা দেখতে চাই। সব তো এক তরফা হওয়ার কথা না।
তবে ভারত যদি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরি আচরণ করে যায়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘিমেয়াদি সমস্যায় পড়তে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।