আসলেই কি জাতি বলে কিছু আছে?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪:২৬:৪৭ অপরাহ্ন
জর্জ অরওয়েল
হোয়াই আই রাইট থেকে অনুবাদ: সারওয়ার চৌধুরী
যখন আমি এই কথাগুলো লিখছি, তখন অত্যন্ত সভ্য মানুষজন আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, চেষ্টা করছে তারা আমাকে হত্যা করার।
তাদের আমার প্রতি ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই, যেমন আমারও তাদের প্রতি নেই। তারা শুধুই তাদের ‘দায়িত্ব পালন’ করছে, এরকম বলা হয়ে থাকে। আমি নিশ্চিত, তাদের অধিকাংশই দয়ালু, আইন মেনে চলা মানুষ, যারা ব্যক্তিগত জীবনে কখনো হত্যার কথা ভাবতেও পারে না।
তবু, যদি তাদের কেউ একটি সঠিকভাবে ফেলা বোমার মাধ্যমে আমাকে টুকরো টুকরো করে দেয়, তাতে তাদের ঘুম একটুও নষ্ট হবে না। তারা তাদের দেশের সেবা করছে, আর তাদের দেশই তাদের সব পাপ থেকে মুক্তি দিচ্ছে।
আধুনিক বিশ্বকে বুঝতে পারা সম্ভব নয়, যদি কেউ দেশপ্রেম এবং জাতীয় আনুগত্যের অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে চিনতে না পারে। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এটা ভেঙে পড়তে পারে, নির্দিষ্ট স্তরের সভ্যতায় এ ধরনের দেশপ্রেম অনুপস্থিত থাকতে পারে, কিন্তু ইতিবাচক শক্তি হিসেবে দেশপ্রেম ও জাতীয় আনুগত্য অতুলনীয়। খ্রিস্টান ধর্ম এবং আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র এর তুলনায় খড়ের মতো দুর্বল।
হিটলার এবং মুসোলিনি তাদের নিজ নিজ দেশে ক্ষমতায় উঠেছিলেন অনেকটাই এই সত্যটি বুঝতে পারার কারণে, যা তাদের বিরোধীরা বুঝতে পারেনি।
এছাড়া, এটা স্বীকার করতেই হবে যে জাতির মধ্যে বিভাজন প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আজকাল পর্যন্ত, এটা বলা ঠিক মনে করা হতো যে সব মানুষ খুব বেশি আলাদা নয়, কিন্তু আসলে, যে কেউ চোখ খুলে দেখলে বুঝতে পারবে যে মানুষের গড় আচরণ দেশভেদে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভিন্ন হয়।
যে জিনিসগুলো এক দেশে ঘটতে পারে, সেগুলো আরেক দেশে ঘটতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, হিটলারের জুন মাসের গণহত্যা ইংল্যান্ডে ঘটবার না। আর পশ্চিমা জাতিদের মধ্যে ইংরেজরা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এর একপ্রকার উল্টোপাল্টা স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় আমাদের (ব্রিটিশ) জাতীয় জীবনধারার প্রতি প্রায় সব বিদেশির বিরক্তির মধ্যে। খুব কম ইউরোপীয়ই ইংল্যান্ডে বসবাস সহ্য করতে পারে। কিন্তু দেখুন, আমেরিকানরা প্রায়শই ইউরোপে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
যখন আপনি অন্য কোনো দেশ থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন, তখনই আপনি যেন এক অন্যরকম বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন বলে অনুভব করেন। প্রথম কয়েক মিনিটেই অসংখ্য ছোট ছোট বিষয় মিলিত হয়ে এই অনুভূতি দেয়। বিয়ারটা বেশি তেতো, কয়েনগুলো ভারী, ঘাসটা আরও সবুজ, বিজ্ঞাপনগুলো আরও চোখে পড়ার মতো। বড় শহরগুলোর ভিড়ে থাকা মানুষেরা, তাদের কোমল গাঁটওয়ালা মুখাবয়ব, খারাপ দাঁত, আর বিনয়ী আচরণ—ইউরোপের অন্য কোনো দেশের ভিড় থেকে আলাদা। তারপর ইংল্যান্ডের বিশালত্ব আপনাকে গ্রাস করে, আর আপনি কিছু সময়ের জন্য ভুলে যান যে পুরো জাতির একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আসলেই কি জাতি বলে কিছু আছে? আমরা কি আসলে ৪৬ মিলিয়ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মানুষ না?
এই বহুমূখিতার ফলে দেখা যায় বিশৃঙ্খলা! ল্যাংকাশায়ারের মিল-ফ্যাক্টরি ঠাসা শহরগুলোতে খড়মের আওয়াজ, গ্রেট নর্থ রোডে ট্রাকগুলোর আসা-যাওয়া, লেবার এক্সচেঞ্জের সামনে লম্বা সারি, সোহো পাবগুলোর পিনটেবলসের ঝনঝনানি, কিংবা শরতের সকালে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে সাইকেলে চড়ে হোলি কমিউনিয়নে যাওয়া বুড়ো কুমারীদের দৃশ্য—এই সবকিছুই শুধু টুকরো নয়, বরং ইংল্যান্ডের চিত্রের স্বতন্ত্র টুকরো সব। কীভাবে এই বিশৃঙ্খলা থেকে একটি নিখুঁত প্যাটার্ন আঁকা সম্ভব?