কেন হিন্দুবিদ্বেষী প্রমাণ করতে চায় বিজেপি মুসলিম বীর টিপু সুলতানকে?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬:৩২ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: আজ থেকে ২৭০ বছর আগে মহীশুরের সুলতান হায়দার আলীর ঘরে জন্ম হয় টিপু সুলতানের। মৃত্যুর বহু বছর পরও তার শাসন, সাহসিকতা, বীরত্বগাঁথা এবং ন্যায়নীতির কথা মানুষ আলোচনা করে।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ কর্নেল মার্ক উইলকেস লিখেছেন, টিপু সুলতান তার বাবা হায়দার আলীর চেয়ে উচ্চতায় খাটো ছিলেন। তাদের রং ছিল কালো। চোখ ছিল বড় বড়। দেখতে ছিলেন একদমই সাধারণ এবং পোশাক-আশাকও ছিল বেশ সাদামাটা। তিনি তার সঙ্গীদেরও এভাবেই চলতে বলতেন।
তাকে বেশিরভাগ সময় ঘোড়ায় চড়তে দেখা যেত। তিনি ঘোড়সওয়ারকে একটি মহান শিল্প বলে মনে করতেন এবং এতে তিনি বেশ দক্ষও ছিলেন। পালকিতে চড়ে বেড়ানো ছিল তার ভীষণ অপছন্দের।
টিপু সুলতানের ব্যক্তিত্বের আভাস পাওয়া যায় ব্রিটিশ লাইব্রেরির ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ টিপু সুলতান’স কোর্ট’ নামে একটি বইতে। টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর তার সচিব মুহাম্মদ কাসিম এক ইংরেজ ইতিহাসবিদকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ।
বইতে লেখা আছে, টিপু মাঝারি উচ্চতার ছিলেন। তার মাথা ছিল চওড়া। নাক উঁচু এবং পাতলা কোমর ছিল। তার গোঁফ ছোট করে ছাটা ছিল এবং তিনি কখনো দাড়ি রাখতেন না। মুখ ছিল পরিষ্কার। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে সবুজ পাগড়ি পরা তার একটি চিত্রকর্ম রয়েছে।
সেখানে দেখা যায় তিনি রুবি এবং মুক্তো দিয়ে জড়ানো সবুজ আলখাল্লা পরে আছেন। কোমরে বাঘের ডোরাকাটা বন্ধনী, বাহুতে বাঁধা বেল্টে একটি লাল খাপের মধ্যে তলোয়ার ঝুলছে।
ভারতের মহীশুরের সাবেক শাসক টিপু সুলতানকে শুধু একজন সাহসী ও দেশপ্রেমিক শাসক হিসেবেই নয় বরং ধর্মীয় সহনশীলতার পথিকৃৎ হিসেবেও স্মরণ করা হয়।
কিন্তু কিছু সময়ের জন্য বিজেপি নেতারা এবং ডানপন্থী মতাদর্শের ইতিহাসবিদরা টিপু সুলতানকে একজন নিষ্ঠুর এবং হিন্দু বিরোধী মুসলমান সুলতান হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। টিপুকে হিন্দুদের গণহত্যাকারী শাসক হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কর্ণাটকের বিগত নির্বাচনি প্রচারের সময় টিপু সুলতান রাজ্যের নায়ক নাকি হিন্দু-বিরোধী অত্যাচারী তা নিয়ে বহুবার প্রশ্ন উঠেছে।
টিপু সুলতানকে মহীশুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে শ্রীরঙ্গপত্তনমে একটি সুন্দর সমাধিতে তার বাবা হায়দার আলী এবং মা ফাতিমা ফখরুল-নাসার পাশে সমাহিত করা হয়।
শ্রীরঙ্গপত্তনম ছিল টিপুর রাজধানী এবং এই শহরে টিপুর শাসনামলের অনেক প্রাসাদ, ভবন এবং বিভিন্ন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এতো বিতর্ক সত্ত্বেও, হাজার হাজার মানুষ এখনও টিপুর সমাধি এবং তার প্রাসাদ দেখতে শ্রীরঙ্গপত্তনমে যান।
জনগণের মনে, মহীশুরের টিপু এখনও একজন দেশপ্রেমিক বীর যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন এবং একজন ধর্মনিরপেক্ষ শাসক। ১৮শ শতকে মহীশুরের শাসক টিপু সুলতান ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন।
ইতিহাসবিদরা জানান, ১৭৯৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জেনারেল জর্জ হ্যারিসের নেতৃত্বে ২১ হাজার সৈন্য ভেলোর থেকে মহীশুর পর্যন্ত যাত্রা করে। ২০ মার্চ, ১৬ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী আম্বারের কাছে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। কুনুরের কাছে জেনারেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে দলছুট ৬ হাজার ৪২০ সৈন্যের একটি দলও এতে যোগ দেয়। তারা সবাই মিলে সারঙ্গাপত্তনমে টিপু সুলতানের দুর্গ আক্রমণ করে।
ধীরে ধীরে তারা সেরঙ্গাপত্তনম দুর্গ ঘেরাও করে এবং ১৭৯৯ সালের ৩ মে তারা কামান দিয়ে আক্রমণ করে রাজধানীর প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে। এরপর ইংরেজ সৈন্যরা পরিখা অতিক্রম করে দূর্গ দখলে নেয়।
মার্ক উইলকেস লিখেছেন, টিপু সুলতান চাইলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার সেনাবাহিনীর সাহস গড়ে তুলতে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে আহত হন টিপু। তিনি দুর্গের ফটকের দিকে এগোতে গেলেই একটি বুলেট তার বাম বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। তার ঘোড়াও মারা পড়ে। তার সৈন্যরা তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালকি করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেটি ব্যর্থ হয়। কারণ ততক্ষণে লাশের স্তূপ হয়ে গেছে।
ব্রিটিশরা তাকে আত্মসমর্পণ করতে বললেও তিনি ব্রিটিশদের হাতে বন্দি না হয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নেন। এই যুদ্ধে সাধারণ সৈন্যদের মতো পায়ে হেঁটে বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ করেছেন তিনি। কিন্তু যখন তার সৈন্যদের সাহস ভাঙতে শুরু করে, তখন তিনি ঘোড়ায় চড়ে তাদের সাহস বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। তখন কিছু ব্রিটিশ সৈন্য দুর্গের ভেতরের গেট দিয়ে প্রবেশ করে এবং তাদের একজন টিপুর তলোয়ার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ততক্ষণে প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে টিপুর প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা।
তারপরও তিনি তার তরবারি দিয়ে সেই সৈনিককে আক্রমণ করেন। তারপর একই তলোয়ার দিয়ে আরেক ব্রিটিশ সৈন্যের মাথায় আঘাত করেন। এক পর্যায়ে টিপু সুলতান মারা যান। মৃত্যুর পরও টিপু সুলতানের চোখ ছিল খোলা। সারারাত তার মরদেহ দরবার হলে রাখা হয়।
এভাবেই তার মৃত্যুর বর্ণনা উঠে এসেছে ইতিহাসবিদদের বইয়ে। পরদিন সন্ধ্যায় টিপুর ব্যক্তিগত কর্মচারীরা তার মরদেহ রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে আনে এবং জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করেন। লালবাগে বাবা হায়দার আলীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
তার জানাজায় অসংখ্য মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। গ্রেট ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ স্কটল্যান্ড’-এ রক্ষিত নথি অনুসারে, ‘জার্নাল অফ দ্য ওয়ার উইথ টিপু’-তে লেখা আছে যে যুবরাজ আবদুল খালিক তার জানাজায় ঠিক পিছনের সারিতে ছিলেন। তাদের পেছনে ছিলেন আদালতের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। যে রাস্তা দিয়ে টিপু সুলতানের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার দুপাশেই ছিল অসংখ্য মানুষের ভিড়।
তারা মাটিতে শুয়ে জানাজায় শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং সুলতানের মৃত্যু শোকে চিৎকার করে কাঁদছিলেন। তখন পর্যন্ত ব্রিটিশরা ভারতে টিপুর মতো রাজার মুখোমুখি হয়নি। টিপুর পর ব্রিটিশদের যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ বাকি ছিল না।
কর্ণাটকের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার কয়েক বছর আগে রাজ্যের অন্যান্য নায়কদের সঙ্গে টিপুকে কর্ণাটকের জাতীয় নায়ক হিসাবে ঘোষণা করে এবং তার জন্মবার্ষিকীতে আনুষ্ঠানিক উদযাপন শুরু করে। তবে বিজেপি ও আরএসএস এর বিরোধিতা করে। তাদের মতে, রাজ্য সরকার শুধুমাত্র মুসলমানদের খুশি করার জন্য টিপুর জন্ম উদযাপন করেছে।
রাজ্যের বিজেপি নেতা অনন্ত কুমার হেগড়ে বলেছেন, টিপু একজন ধর্মান্ধ শাসক ছিলেন যিনি হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা করেছিলেন এবং উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। টিপু বীর নয়, হাজার হাজার হিন্দুর খুনি ছিলেন।
টিপুর সাম্রাজ্যে হিন্দুরা ছিল প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠ। টিপু সুলতান ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং জ্ঞানার্জনের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি অনেক মন্দির তৈরি করেছিলেন এবং শ্রীরঙ্গপত্তনম, মহীশুর এবং রাজ্যের অন্যান্য অনেক জায়গায় মন্দিরের জন্য জমি দিয়েছিলেন।
তার নিজের প্রাসাদের প্রবেশপথ থেকে মাত্র কয়েকশ মিটার দূরে এক বিশাল মন্দির অবস্থিত। কিন্তু হিন্দুত্ববাদে প্রভাবিত অনেক বুদ্ধিজীবী এবং ইতিহাসবিদ টিপুকে এক নিষ্ঠুর এবং হিন্দু বিরোধী শাসক হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন।
কর্ণাটকের ড. চাঁদানন্দ মূর্তি, কন্নড় ভাষায় টিপু সুলতানকে নিয়ে লেখা বই ‘টিপু ইন কান্নাড়া’-তে লিখেছেন যে তিনি খুবই ধূর্ত শাসক ছিলেন। তিনি মহীশুর রাজ্যের মধ্যে তার হিন্দু প্রজাদের ওপর কোনো অত্যাচার করেননি এবং তাদের উপাসনালয়েরও ক্ষতি করেননি। কিন্তু নিজ রাজ্যের বাইরে কেরালার উপকূলীয় কুর্গ অঞ্চল এবং মালাবার অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে তিনি হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক অত্যাচার চালান।
ড. মূর্তি লিখেছেন, তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর, নির্দয় ও ধর্মান্ধ এক শাসক। তিনি ছিলেন একজন জিহাদী। তিনি হাজার হাজার হিন্দুকে জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেছিলেন।
‘টিপু ইন কান্নাড়া’ শীর্ষক বইতে আরো বলা হয়েছে, টিপু তার ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসরণ করতেন, যেখানে মূর্তি পূজারীদের হত্যা করতে বলা হয়েছে।
ইতিহাসবিদ রবি ভার্মা, টিপু সুলতানের ওপর রচিত তার প্রবন্ধে লিখেছেন ‘কেরালায় টিপুর সামরিক অভিযান সম্পর্কে একাধিক প্রামাণ্য নথি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে মহীশুরের টিপু সুলতান একজন ধর্মান্ধ মুসলিম নিপীড়ক ছিলেন যিনি কেরালায় শত শত মানুষকে হত্যা করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের বহু মন্দির ধ্বংস করেছেন, জোরপূর্বক বিপুল সংখ্যক হিন্দুকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছেন এবং হিন্দুদের ওপর চরম অত্যাচার চালিয়েছেন।
রবি ভার্মা বেশ কয়েকটি মন্দিরের তালিকাও দিয়েছেন যা টিপু সুলতান ধ্বংস করেছিলেন বলে তিনি দাবি করেন। কিন্তু ইতিহাসের অধ্যাপক বি. শেখ আলী, যিনি টিপুকে নিয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন, তিনি বলেছেন যে এই দাবির কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
তার মতে, অত্যাচারী শাসক হিসেবে টিপুর নতুন ভাবমূর্তি ইতিহাসের চেয়ে বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ দ্বারা বেশি প্রভাবিত।
তিনি বলেছেন, মুসলমানরা যখন ক্ষমতায় এসেছে তখন তারা নিজেদের মতো ইতিহাস রচনা করেছে, ব্রিটিশরা আসার পর তাদের মতো করে ইতিহাস লিখেছে। এখন দল পাল্টেছে তাই নেতারা চায় নিজেদের মতো ইতিহাস পরিবর্তন হোক। তারা ইতিহাস বিকৃত করতে চায়।’
অধ্যাপক আলী বলেন, ইতিহাসকে তার সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বস্তুনিষ্ঠভাবে বুঝতে হবে।
দেশের পরিবর্তিত রাজনীতিতে ইতিহাসের পুনর্ব্যাখ্যা হচ্ছে। এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে চেষ্টা হচ্ছে ভবিষ্যৎ ইতিহাসে টিপু সুলতানের মতো অতীতের শাসকদের মুছে দিতে বা তাকে একজন হিন্দুবিরোধী, অত্যাচারী শাসক হিসেবে চিত্রিত করতে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা